ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিব কন্যা, বাইয়া যাওরে... ;###;শাহীন রেজা নূর

‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরী’

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৯

‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরী’

এবারের নির্বাচনী লড়াইটি সর্ব বিচারেই ছিল অস্তিত্বের লড়াই। দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী-অসাম্প্রদায়িক ধারায় চলবে, নাকি পাকিস্তানবাদী সেই বস্তাপচা প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক ধারায় চলবে তারই অগ্নিপরীক্ষা ছিল এই নির্বাচন। এ দেশের মানুষ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপরই অবলীলায় আস্থা রাখতে চেয়েছে। অন্য নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, সেগুলোকে কোন না কোনভাবে ম্যানুপুলেট বা ইঞ্জিনিয়ারিং করে সেনা শাসকরা বা বাংলাদেশবিরোধী বিএনপি-জামায়াত চক্র জনগণের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের আমলের গণভোট ও সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলের নির্বাচনগুলোর সবই ছিল নানা মাত্রার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফসল। দীর্ঘ ২১/২২ বছর ক্ষমতার মসনদ দখল করে রেখে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে তথাকথিত ‘মুসলিম বাংলা’ বা মিনি পাকিস্তান বানাবার স্বপ্নে বিভোর ছিল ঐ অপরিণামদর্শী শাসকরা। ওরা ধর্মের মিথ্যা দোহাই পেড়ে এ দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করেছে দীর্ঘকাল। কিন্তু ওদের জানা ছিল না যে, এই দেশে ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। সুতরাং, পতন যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন তাদের বোধ-বুদ্ধি-চিন্তা-চেতনা সব কিছু স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই নিজেদের অলক্ষ্যে লোপ পেতে শুরু করে! ওদের চোখে শেষাবধি স্বার্থের ঠুলি লাগানো থাকে বিধায় ওরা এই সত্যটাই বুঝতে পারে না যে, তাদের নিজেদের পতনের ঘণ্টা বেজে গেজে! নির্বাচনে বিএনপির এমন গোহারা হাবার কারণ খুঁজে বের করা কি আদৌ কোন কঠিন কাজ? নিশ্চয়ই নয়। এই পরাজয়ের পেছনে এক শ’ একটি কারণ দেখানো যাবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, বিএনপি-জামায়াত বা ঐক্যফ্রন্ট তা মানবে না, বরং একের পর এক ষড়যন্ত্র করেই চলবে যাতে কিনা এই নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়! এই যে তাদের নেতিবাচক এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতি তা বর্তমানের বাংলাদেশে যে একেবারেই অচল সেটি বুঝতে না পারা তাদের এক চরম ব্যর্থতা বৈ নয়! খোলা চোখেই তাদের এই গ্লানিকর ও লজ্জাজনক হারের কিছু কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। আর সেগুলো নি¤œরূপ: ১) বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের মাঠে শুধু নামকাওয়াস্তে হাজিরা দিয়ে এই চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল যাতে কিনা সকলকে এই ধোঁকাটা দেয়া যায় যে, তাদেরকে মাঠে নামতেই দেয়া হচ্ছে না এবং তাদের কর্মীদের গ্রেফতার করে এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, নির্বাচন তাদের পক্ষে করা সম্ভবই হচ্ছে না। অথচ, বাস্তবে ভোটাররা এবং অন্য সকলেই দেখতে পেল যে, তারা ইচ্ছে করেই পোলিং এজেন্টদের নিয়োগ দিচ্ছে না আর তাদের মনোনীত প্রার্থীদের সকলেই সারাদেশে সব শিয়ালের এক রা-এর মতো একত্রে অর্কেস্ট্রেটেড অভিযোগ তোলা শুরু করলেন। সকলেরই একই অভিযোগ, ‘ভোট নিরপেক্ষ হচ্ছে না’, ‘আমাদের দাঁড়াতেই দিচ্ছে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ যখন এসব অভিযোগের অধিকাংশই ভুয়া ও বানোয়াট বলে দেখতে পেল তখন ওদের প্রতি আস্থা রাখার আর কারণ থাকতে পারে না নিশ্চয়ই! ২) বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা নিজেদের অতিরিক্ত সেয়ানা বলে মনে করেন আর তাই অতিরিক্ত চালাকি করতে গিয়ে এমন ধরাটা খেতে হলো তাদের। কথায় বলে না, ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’- এদের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। উপরন্তু, তাদের গণসম্পৃক্তি এতই ভঙ্গুর ও নাজুক যে, উপর দিয়ে যতই বাগাড়ম্বর তারা করুন না কেন ভেতরে ভেতরে তাদের নিশ্চিত জানা ছিল যে, এ নির্বাচনে ‘তাদের পক্ষে চিড়ে ভেজার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সুতরাং জনগণের মুখোমুখি না হয়ে চক্রান্তের পথকেই তারা অধিক নিরাপদ বলে ভেবে নিয়েছিলেন। ৩) যুদ্ধে নেমে সৈন্য-সামন্তকে যুদ্ধ না করতে বলা যে কত বড় অপরিণামদর্শিতা তা তারা উপলব্ধিই করতে পারেননি। নির্বাচনের মতো যুদ্ধে যাচ্ছি অথচ ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার বা ডন কুইক্সট সেজে রওনা হওয়া কেবল আহাম্মকের স্বর্গের বাসিন্দারাই করতে পারেন নয় কি? ৪) তাদের হেভিওয়েট নেতা ও উপদেষ্টাদের অনেকের ষড়যন্ত্রমূলক টেলি-কথোপকথন ফাঁস হয়ে পড়তে থাকায়, বিশেষ করে কর্মীদের সহিংসতার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দান আর পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে এই নির্বাচন ভ-ুল করার ব্যাপারে দহরম-মহরম দেশের মানুষ কোন অবস্থাতেই ভাল চোখে দেখেনি। বিশেষ করে ২০১৪’র নির্বাচন প্রতিহতকারী আগুন সন্ত্রাস ও সহিংসতার স্মৃতিকাতরতা থেকে মানুষ যে আজও বেরুতে পারেনি তা এদের নজরেই পড়েনি। ৫) বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের যাচ্ছেতাই মনোনয়ন বাণিজ্য দলের কর্মী মহলকে হতাশার আবর্তে নিমজ্জিত করেছে। ৬) ড. কামাল, আ স ম রব, কর্নেল অলি প্রমুখের জঘন্য প্রকৃতির অসহিষ্ণুতা এবং সাংবাদিক, পুলিশ বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের অসদাচরণ কোন পক্ষই পছন্দ করেনি। আ স ম রব একবার এমন কথাও বলতে চেয়েছেন যে, তিনিই ‘স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক’, এমনকি বঙ্গবন্ধুকে তিনিই প্রথম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করেন। ভাবখানা এই যে, তিনি না বললে বঙ্গবন্ধু আর জাতির পিতা হতেই পারতেন না। সাংবাদিকরা তার, ড. কামালের ও কর্নেল ওলির অতীত রাজনীতি প্রসঙ্গে টক শোতে একটি-দুটি প্রশ্ন করলেই এদের সকলকে রীতিমতো অভব্য অসদাচরণ করতে দেখা গেছে। ড. কালামের সাংবাদিকদের ‘খামোশ’ ও পুলিশদের ‘জানোয়ার’ বলাটা কতটা ভদ্রজনোচিত ও কতটা অভব্য তাও ভোটাররা হিসেবে নিয়েছেন বৈকি! ৭) দেশের সর্বস্তরের মানুষ যে এবার শেখ হাসিনার দৃশ্যমান উন্নয়নের এবং তার অসাধারণ কারিশমায় মুগ্ধ হয়ে রয়েছে এটি ঐ স্বাধীনতাবিরোধী-অগ্নিসন্ত্রাসী-জঙ্গী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নজরেই পড়েনি। কারণ তারা দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের পথকে সুগম করার পরিবর্তে কেমন করে স্বাধীনতার পক্ষের সব অর্জনকে বানচাল করে দেয়া যায় সেই মতলবেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থেকেছে। ফলে দেশের মানুষ তাদের ওপর আর ভরসা করতে পারেনি। ৮) দেদার টাকা ছড়িয়ে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মানুষকে বোকা বানাতে চেয়েছে; কিন্তু দেশের মানুষ যে তাদের প্রতারণা, মিথ্যাচার, কুমতলব, জাল-জোচ্চুরি সব এখন বিলক্ষণ বুঝে ফেলেছে এটাও তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। ৯) জামায়াতকে ত্যাগ না করা এবং জামায়াতকে নিয়ে ড. কামাল, আ স ম রব-কাদের সিদ্দিকী-মান্না-সুলতান মনসুর-মির্জা ফখরুল ও অন্যান্যের লুকোচুরি, জারি-জুরি আর প্রকাশ্যে প্রতারণামূলক আচরণ এবং কথাবার্তায় মানুষ দারুণভাবে বিরক্ত হয়েছে। ১০) ২০১৪’র সহিংসতার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা না চাওয়া, আওয়ামী লীগের উন্নয়নধারাকে অস্বীকার করা, কথায় কথায় সারাসার মিথ্যা বলা, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার মতো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেত্রীদের জামায়াত ও বিএনপি একই মায়ের পেটের দুই ভাই বলে গর্ব করা- এ সবই তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। ‘বাঘের বাচ্চা’ বলে ইউটিউবে আপলোড করা আন্দালিব পার্থ বা আসিক নজরুলদের তর্জন-গর্জন যে কত অসার তাও জনগণের বুঝতে এবার আর বেগ পেতে হয়নি। ১১) বিএনপি মহাসচিব মহাশয়ের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা কি প্রচ-ভাবে ব্যাকফায়ার করেছে তা তো নির্বাচনে তার নিজ পৈত্রিক ভূমিতেই ধরাশায়ী হওয়ার ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখলাম আমরা। দলের অত উঁচু পদে থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যখন এ ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেন তখন তার নীতিবোধ ও নৈতিকতা নিয়ে জনমনে বিরাট প্রশ্ন দেখা দেয়াই তো স্বাভাবিক। মুক্তিযোদ্ধার ভেকধারী এই নেতা জাতির উদ্দেশে একাত্তর টিভি মারফত মুক্তিযুদ্ধকে সুকৌশলে জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতির পক্ষে ব্যবহার করতে গিয়ে সেদিন যে আত্মহত্যাই করে বসেছেন তা বোঝার মতো বিচক্ষণতাটুকুও নেই এই ‘মহান’ ও ‘কিèন ইমেজে’র নেতার! সেদিন তার এই অসাধুতার পক্ষে সাফাই গাইতে বিএনপির অপর এক নেতা জনাব মান্নান যে সব ছল-চাতুরির আশ্রয় নিলেন ও রীতিমতো নাটক করলেন এবং একজন শহীদ সন্তানের আকুল আর্তনাদকে কটাক্ষ করলেন তাও যে তাদের পরাজয়ে বড় উপাদান হিসেবে কাজ করেছে এ কথাটিও তাদের বোধগম্য হওয়া দরকার নিজেদের ও দলের স্বার্থে। ১২) ড. কামাল, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী ও মান্না প্রমুখের মতো সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের কাঁধে সওয়ার হয়ে বৈতরণী পার হওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। তারা এক্ষেত্রে সাপের পাঁচ পাও দেখেছিলেন। আর তাই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ‘ভোট বিপ্লবে’র মাধ্যমে দেশের রাজত্ব ফিরে পাওয়া তারেকের ফের ‘রাজা বনা’র শখ এত প্রবলরূপ নিয়েছিল তাদের মনে। কিন্তু ‘বিধি বাম’- তাই ব্যালট বিপ্লব ঘটেছে ঠিকই, যা তাদের পক্ষে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ঘটে গেছে’। আর একেই বুঝি বলে ‘নেমিসিস’- এই বুঝিবা প্রকৃতির প্রতিশোধ। এমনি আরও অনেক ঘটনাই তুলে ধরা যাবে তাদের এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে। যাক, ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই বিধায় এ ক্ষেত্রে ক্ষান্ত দিচ্ছি। তবে এটিও ঠিক যে, বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট চক্র এখন নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকবে তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে। এরা কিছুকাল হয়ত শীত নিদ্রায় বা হাইবারনেশনে যাবে, তারপর খোলস বদলে অন্ধকারের বিবর থেকে আবারও বাইরে বেরিয়ে আসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছোবলে ছোবলে জর্জরিত করার উদ্দেশ্যে! তাই আমাদের সকলকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো চোখ-কান খোলা রেখে এদের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম, গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা, মানুষের প্রতি কল্পনাতীত মমত্ববোধ, সততা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা আর দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট ভরসাস্থল। আমি বঙ্গবন্ধু নন্দিনী আমাদের প্রজন্ম ’৭১-এর ভাই-বোনদের সকলের প্রিয়তম আপার উদ্দেশে শুধু বলতে চাই, ‘মুজিব কন্যা, তুমি বাইয়া যাওরে/ সম্ভাবনার বাংলাদেশে জনগণের নাও- তুমি বাইয়া যাওরে’। হে মহান নেত্রী, তোমার এই বিপুল ও দুনিয়া কাঁপানো বিজয়কে সামনে রেখে আরও বলে যাব, ‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী/আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরী’। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×