ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কাজ শুরু করেছে শিল্পকলা একাডেমি

৬৪ জেলায় ৬৪ যাত্রাপালা, ঐতিহ্যবাহী ধারা বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ জানুয়ারি ২০১৯

৬৪ জেলায় ৬৪ যাত্রাপালা, ঐতিহ্যবাহী ধারা বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ

মোরসালিন মিজান ॥ এখন যাত্রাপালা মানেই ফেলে আসা দিন। বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখার দারুণ সব সুখস্মৃতি। সারারাত বাইরে কাটানো। পরদিন বাবা-মায়ের বকুনি। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুম। আজ ভাবতে অবাক লাগে-কখন যেন, কীভাবে যেন সব হারিয়ে গেছে। একটা আফসোস তো হয়ই। কিন্তু আফসোসই শেষ কথা নয়। লোকসংস্কৃতির অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ধারাটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জোর দাবি ছিল। যাত্রাশিল্পীরা-সংগঠকরা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছিলেন এ দাবি। লোক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ মাত্রই শিল্পটির পুনর্জীবনের পক্ষে মত দিয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব আরও বেশি। কয়েক বছর ধরে যাত্রাপালা নিয়ে একাডেমি কিছু না কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি নেয়া হয়েছে খুবই উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। এবার দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা প্রযোজনা করা হবে। প্রতিটি জেলার জন্য একটি করে পালা নির্বাচন করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে বাস্তবায়নের কাজ করছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি। কী যে আশার কথা! পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যখন যাত্রাপালা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, যখন দুর্বলতার সুযোগে ঢুকে পড়েছে স্থ‍ূলতা অশ্লীলতা, যাত্রার অনুমতি দিতে প্রশাসনের গড়িমসি যখন, যখন মূল ধারার একটি দল গঠন করতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লগ্নি করতে হয়, বিপরীতে সামান্যই ওঠে আসে তখন শিল্পকলা একাডেমির এগিয়ে আসা তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি। হ্যাঁ, বর্তমানে বিষয় ও গুণগত দিক থেকে যাত্রাপালায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক গল্পের পাশাপাশি সমকালীন সমাজ বাস্তবতা রাজনীতি কথা বলছে যাত্রার ভাষায়। যতদূর তথ্য- সবদিক মাথায় রেখেই ৬৪টি পালা নির্বাচন করা হয়েছে। একাডেমি সূত্রে জানা যায়, চর্চাটি নতুন উদ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ৬৪ জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঢাকায় হচ্ছে যাত্রাপালা ক্ষণিকের দুনিয়ায়, সিলেটে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সুনমাগঞ্জে নদীয়ায় নিমাই, নরসিংদীতে বনবাসী রূপবান, ময়মনসিংহে আশার সৌধ, মানিকগঞ্জে সাগর ভাসা, চাঁদপুরে আলোমতি ও প্রেমকুমার, নোয়াখালীতে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে লাইলি মজনু, গোপালগঞ্জে গুনাইবিবি, হবিগঞ্জে কমলা সুন্দরী, দিনাজপুরে জলন্ত বারুদ, পঞ্চগড়ে গরীবের আর্তনাদ, নাটোরে রাজা হরিশচন্দ্র, ঠাকুরগাঁয়ে শাপমোচন, বরিশালে দাতা হাতেম তায়ী, নওগাঁয় মধুমালা, গাজীপুরের ইতিহাস তুলে ধরতে সেখানে হচ্ছে ভাওয়াল রাজা সন্ন্যাসী, খুলনায় মাটি আমার মা এবং শেরপুরে সুজন মালা। এর আগে বহু প্রতীক্ষিত যাত্রা-নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সে আলোকে চলছে নিবন্ধন কার্যক্রম। ইতোমধ্যে ১০৬টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন দিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। একই উদ্দেশে গত ১২ ও ১৩ নবেম্বর একাডেমিতে দশম যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে ‘ঈশা খাঁ’ শিরোনামে একটি প্রতœযাত্রা নির্মাণ করা হয়েছে। মুনীর চৌধুরী রচিত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটককে যাত্রাপালায় রূপান্তর করে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে আরও পাঁচটি যাত্রাপালা নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। এদিকে, নির্বাচিত যাত্রাপালার কয়েকটি ইতোমধ্যে পরিবেশিত হয়েছে। দেখার সুযোগ পেয়েছেন দর্শক। প্রশংসিতও হয়েছে। আবার কোন কোন যাত্রাপালাকে মনে হয়েছে নাটক। যাত্রা লোকনাট্যের একটি ধারা বটে। নাটক নয়। যাত্রাপালা চর্চার স্বীকৃত পদ্ধতি ও নিজস্ব উপস্থাপনা রীতি বর্তমান। পরিবেশিত সব নাটকে তা অনুসরণ করা হয়নি। এ অবস্থায় উদ্যোগটি সফল করতে একাডেমিকে আরও সতর্ক হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন যাত্রাপ্রেমী দর্শক। এ প্রসঙ্গে কথা হয় যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে দীর্ঘ জীবন ব্যয় করা শিল্পী মিলন কান্তি দে’র সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, যাত্রাশিল্পের পুনরুজ্জীবনে শিল্পকলা একাডেমি যেসব ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। যাত্রা নিয়ে আমাদের অনেকেরই ইমোশন আছে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে, যাত্রাপালা নাটক নয়। যাত্রার স্বকীয়তা ধরে রাখতে হবে। যাত্রাকে যাত্রা বলে মনে হতে হবে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি এসব বিষয়ে অবগত কিনা, সে ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণ বা যথাযথ নির্দেশনা দেয়ার পরামর্শ দেন। তা না হলে শুধু শুধু সরকারের অর্থ নষ্ট হবে বলে সতর্ক করে দেন প্রবীণ এই যাত্রাশিল্পী ও গবেষক। যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে গ্রহণ করা পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা ধরে রাখারও পরামর্শ দেন তিনি। একই প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, যাত্রা আমাদের মৌলিক সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ। ধারাটি রক্ষায় ও এগিয়ে নিতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে শিল্পকলা একাডেমি। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৪ জেলার প্রতিটিতে একটি করে যাত্রাপালা নির্মিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে পরামর্শ করে কাজ করছে একাডেমি। যাত্রার বৈশিষ্ট্য অটুট রাখার ব্যাপারে সচেতন আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে আরও সতর্ক হবে একাডেমি। আর তা হলে চমৎকার প্রাপ্তি যোগ হবে যাত্রাশিল্পে। একটা গতি পাবে। সকলের সহযোগিতায় টিকে থাকুক প্রাচীন ও সরল এই শিল্পভাষা। আমাদের তা-ই প্রত্যাশা।
×