ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

ভরাডুবির ময়নাতদন্ত

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৭ জানুয়ারি ২০১৯

ভরাডুবির ময়নাতদন্ত

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবে এটা সকলেরই ধারণার মধ্যে ছিল। দেশের মানুষের ইচ্ছার কথা তো সহজেই আঁচ করা যাচ্ছিল। এছাড়াও গার্ডিয়ান, ইকোনমিস্ট এবং সিএনএনের মতো বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমসমূহ মতামত জরিপের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পূর্বাভাস দেয়ার পর, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনই অবকাশ থাকেনি। কিন্তু বিএনপি এবং ঐক্যজোট যে ৩০০ আসনের মধ্যে কেবল ৭টি আসন পেয়ে লজ্জায় মুখথুবড়ে পড়বে, এটা কিন্তু অনেকেরই ভাবনার বাইরে ছিল। মনে করা হয়েছিল, বিএনপি জোট হয়ত ৩০টির কাছাকাছি আসন পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি জোটের কেন এ ধরনের ভরাডুবি হলো? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এ ভরাডুবির কারণ একাধিক- জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধী সঙ্গ যারা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের সঙ্গে বিএনপির সখ্য নতুন কিছু নয়। বরং এটি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই বলা চলে যে- মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, ’৭১-এ ভারতে থাকাকালীন আসলে পাকিস্তানী চর হিসেবেই কাজ করছিলেন এবং তিনি কোন যুদ্ধেই অংশ নেননি সে ব্যাপারে বহু প্রমাণ ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনা যে জিয়াই করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর ভাষ্য তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে যে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানীকরণ, তাও আজ ক্রিষ্টাল পাথরের মতোই স্বচ্ছ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ’৭১-এর সকল পরাজিত অপশক্তি জিয়ার মধ্যে খুঁজে পেল তাদের ত্রাণ কর্তাকে। জিয়া একে একে স্বাধীনতার পর পালিয়ে যাওয়া সব যুদ্ধাপরাধী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে এনেই খান্ত হননি, তাদের ক্ষমতার অংশীদার করতে, সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য সাহায্য করতে ছিলেন নিরলস। জয় বাংলা ধ্বনিসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি নির্বাসনে পাঠিয়ে জিয়া অবিমিশ্রিতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ওপাড় গিয়েছিলেন পাকিস্তানী চর হিসেবেই। তার কেবিনেটের এক সদস্য ক্যাপ্টেন নুরুল হক স্বীয় আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘হাই টাইম হাই টাইড’-এ লিখেছেন, ‘জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।’ ব্যারিস্টার মওদুদও একই ধরনের কথা লিখেছেন। জিয়া সেই শর্ষিণার পীরকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন। যিনি বলেছিলেন ’৭১-এ পাকিস্তানী সৈন্যদের গণধর্ষণ ছিল জায়েজ। বিএনপির পরবর্তী কর্ণধার খালেদা জিয়া যে পাকিস্তানীদের সঙ্গেই ছিলেন তার প্রমাণ তো ভূরিভূরি। তবে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনা ব্রিগেডিয়ার জানজোয়ার মৃত্যুর পর প্রটোকলের সমস্ত বিধান লঙ্ঘন করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শোকবার্তা পাঠিয়ে এবং সম্প্রতি মুুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তার পাকিস্তানী প্রীতির কথা পুনঃপৌনিকভাবে প্রমাণ করেছেন। তার লন্ডন অবস্থানরত পুত্রের প্রতিনিয়ত পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) সঙ্গে বৈঠক এবং ষড়যন্ত্র, বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আর এক নেতা ড. খন্দকার মোশারফের আইএসআইয়ের সঙ্গে সংলাপ ইত্যাদি সবকিছুই নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে যে, বিএনপিও জামায়াতের মতোই একটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল। এ দলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বটে কিন্তু তারাও কট্টর ভারতবিরোধী বলে এদলে যোগ দিয়েছেন। বহু মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন সেটা তো এবার প্রকাশ্যেই প্রমাণ করলেন কাদের সিদ্দিকী, সুলতান মনসুর, মোস্তফা মোহসিন মন্টুসহ অনেকেই। মেজর জলিল এবং অধ্যাপক আফতাবও তো পরবর্তী সময়ে জামায়াতের চেয়েও বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। নতুন প্রজন্মের ভূমিকা এবার কম বেশি আড়াই কোটি নতুন ভোটার ভোট দিয়েছেন। শাহবাগের গণজারণ প্রমাণ করেছে যে, যারা ’৭১-এ পাকিস্তান এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের পৈশাচিকতা দেখেননি, শুধু গুরুজনদের কাছ থেকে বা লিখনি থেকে জেনেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের ব্যাপারে তারা আমাদের প্রজন্মের চেয়েও বেশি অগ্রণী। এই তরুণরাই তো ‘জয় বাংলা’ মুক্তিধ্বনি এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত গানসমূহ ফিরিয়ে এনেছিলেন, জিয়া যেগুলো দেশান্তরিত করেছিলেন। এই নতুন ভোটারদের স্লোগান ছিল ‘নতুন ভোটার, প্রথম ভোট, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোক।’ তারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য, বিশেষ করে জামায়াতের সাঈদী, সাকা চৌধুরীর ছেলেদেরসহ ২২ জন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের নমিনেশন দেয়া, যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ছেলেকে সমর্থন দেয়া প্রভৃতি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি বলে ভোট বিপ্লব ঘটিয়েছেন। ২২ জামায়াতীকে ধানের শীষ দিয়ে বিএনপি আবার প্রমাণ করল যেÑ বিএনপি এবং জামায়াত অভিন্ন। কিছুদিন আগে লন্ডনে তারেক জিয়া প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিএনপি এবং জামায়াত একই মায়ের দুই সন্তান। নতুন প্রজন্মের দৃঢ় ধারণা বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার প্রক্রিয়া চালাবে, যার সূচনা করেছিলেন এ দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এরা ক্ষমতা পেলে দেশ আবার ভরে যাবে সিআইএর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে, আবারও ঘটবে বহু দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যৌক্তিকভাবেই অত্যন্ত জোরালো অবস্থানে ছিল। ’৭১-এ যারা দেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বিশ্বের জঘন্যতম বর্বরতার দ্বার খুলে দিয়েছিল, তাদের বিচারের সকল প্রস্তুতি নেয়া হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তানী চর জিয়া সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানপন্থীদের শাসন আমলে এ বিচারের কথা ভাবাই যায়নি। ২০০৯-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে শুধু বিচারের ব্যবস্থাই করেননি রায়ও কার্যকর করেছেন। দেশে-বিদেশে বহু প্রভাবশালীর অনুরোধ ও দাবি উপেক্ষা করে মুজিবকন্যা অনুকরণীয় দৃঢ়তা দেখিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকর করে। অন্যদিকে বিএনপি এবং এমনকি ড. কামালও ওই বিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। এই বিচারের পক্ষে যে জোরালো জনসমর্থন রয়েছে তারও প্রতিফলন ঘটল এই ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে। খুনীদের দল ২০০১-এর নৃশংস ঘটনাবলী, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর নির্যাতনের কথা এবং ২০১৪ সালে তিন মাসব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে শত শত লোককে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা এবং সারা শরীর ঝলসিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্বে ফেলে দেয়ার অমানবিক ঘটনাবলী মানুষ ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি তারেক জিয়ার নেতৃত্বে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা। এসব লোমহর্ষক ঘটনা, যা বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করেছিল, বিএনপিকে খুনীদের দলের পরিচয়ে ঠেলে দিয়েছে। ভোটারগণ এমন খুনীদের ক্ষমতায় দেখতে চাননি। খালেদা ও তারেকের দুর্নীতি বিএনপি নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব বলতেন খালেদাকে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষিপ্ত করায় নাকি প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছিল। কিন্তু উল্টোটাই যে ঘটেছিল, তা হয়তো তারা আঁচ করতে পারেননি, নয়ত সত্যটি জেনেও জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমনটি বলতেন। এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল যে, দুর্নীতির দায়ে খালেদা এবং তারেকের সাজাতে জনগণ উৎসাহিতই হয়েছেন। তারা রাজনীতি থেকে দুর্নীতিবাজদের বিতাড়নেরই পক্ষে। এ মামলা দুটিতে যে আওয়ামী লীগ সরকারের কোন ভূমিকা ছিল না, সেটাও কিন্তু জনগণের কাছে অজানা ছিল না। অভাবনীয় উন্নয়ন বাংলার আপামর জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দৃশ্যমান উন্নয়নের অভাবনীয় জোয়ারে অভিভূত হয়েছেন, এ কথা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশে উন্নয়নের ঘটনাবলী চমক লাগিয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। শুধু প্রেসিডেন্ট ওবামাই নয়, এমনকি পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বাংলাদেশের উন্নয়নে ঈর্ষান্বিত বলে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দারিদ্র্য সীমা নেমেছে ১২%, জিডিপির হার ৭.৮-এ উন্নীত হয়েছে, বিদেশী অর্থের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছেন ৮৩ শতাংশ লোক, যে লোডশেডিং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল, তা নেই বললেই চলে। বিদ্যুত উৎপাদন উন্নিত হয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বিদ্যুত উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাবে এটা সবারই বিশ্বাস। সৌরবিদ্যুতেও ঘটেছে যুগান্তকারী সাফল্য। দ্বারে দ্বারে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর জন্য এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬ সহস্র কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ৩০ ধরনের ওষুধ দেয়া হচ্ছে সারা দেশে বিনামূল্যে, দশ বছরে ২১ জেলায় মেডিক্যাল কলেজ এবং সারাদেশে তিনটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সকলকে বিস্মিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭০-এর উর্ধে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু অনেক কমেছে। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাওয়ার পর সবার উৎকণ্ঠা ভুল প্রমাণিত করে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান- যা কিনা আমাদের অর্থনীতিতে আনবে নতুন জোয়ার। বাংলাদেশ আজ গার্মেন্টস রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। নতুন সংযোজন রয়েছে ১৫১ দেশে ওষুধ রফতানি, জাহাজ রফতানি ইত্যাদি। পাটকে আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে পুরনো ঐতিহ্যে। খাদ্যাভাব, অনাহার, বিদায় নিয়েছে বাংলার মাটি থেকে। দেশ আজ নিজস্ব উপগ্রহের মালিক। পায়রা এবং সোনাদিয়া বন্দর দেশে আনবে অচিন্তনীয় অর্থনৈতিক বিপ্লব, তাও সবাই অনুধাবন করেছেন। এবারও ৩৫ লক্ষাধিক পুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। এর সবই সম্ভব হয়েছে জনগণের জন্য শেখ হাসিনার অবিচ্ছেদ্য অনুভূতির জন্য। প্রমাণিত হয়েছে দেশের উন্নয়নই তার একমাত্র ধ্যান-ধারণা। কোন অতীত সরকারই উন্নয়নে এর কাছাকাছি সাফল্যও আনতে পারেনি। ভোটাররা নিশ্চিত ছিল উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হাসিনার বিকল্প নেই। সমুদ্র ও ছিটমহল জয় শেখ হাসিনা সরকারের ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে সমুদ্র সীমা জয়। আন্তর্জাতিক আইন মতে সালিশি আদালতে কোন পক্ষকে তদ্বীয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেয়া যায় না। শেখ হাসিনা বার্মা এবং ভারতকে আন্তর্জাতিক সালিশি ট্রাইব্যুনালে যেতে উদ্বুদ্ধ করে মহান রাষ্ট্রনায়ক সুলভ কাজটিই করেছেন। যে ছিটমহল সমস্যা যুগ যুগ ধরে ছিটমহলবাসীদের মানবেতর পর্যায়ে বসবাসে বাধ্য রেখেছিল, শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে তার সমাধান করে অসাধ্যই সাধন করেছেন। এই সমাধান মোটেও চাট্টিখানি কথা ছিল না। এর জন্য ভারতের সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হয়েছিল, যার জন্য প্রয়োজন ছিল লোক সভায় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যর সম্প্রতি সূচক ভোট। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আদায় করা প্রয়োজন ছিল। এই সমস্যাগুলো দশকের পর দশক জিইয়ে রেখেছিল জিয়া এবং খালেদা জিয়া সরকার। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন জিয়াউর রহমান তার ঘনিষ্ঠজন জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর সাহায্যে। শেখ হাসিনার কৃতিত্ব এই যে, তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী দেশসমূহের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন। যারা আমাদের বিরুদ্ধে ছিলেন তাদের মধ্যেও ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের হাওয়া দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তি হাসিনার জনপ্রিয়তা শেখ হাসিনা যে বিশাল ব্যবধানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, সে কথা কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসমূহই বলেছে। সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত মতামত জরিপ অনুযায়ী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা ৬৯% যেখানে খালেদা জিয়ার অবস্থান মাত্র ২১%-এ। হাসিনা শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের বিরল সৎ রাজনীতিবিদের অন্যতম। দুর্নীতি কখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। এ কথা তাঁর তুখোড় সমালোচকরাও অস্বীকার করেন না। শিল্পী, সাহিত্যিক ও ক্রীড়াবিদদের ভূমিকা এবারের নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল চলচ্চিত্র শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, অঙ্কন শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, কবি, সাহিত্যিক, নৃত্য শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জোট, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, শিক্ষককূল প্রমুখদের আওয়ামী লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসা। তাদের প্রায় কারোরই কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না- শুধু দেশের মঙ্গলের কথা ভেবে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা ভেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মনে রেখেই তারা শেখ হাসিনার সমর্থনে পথে নেমেছিলেন। তাদের একাগ্র ভূমিকাও ভোটারদের প্রভাবিত করেছে। তারেকের নমিনেশন বাণিজ্য বিএনপি উপযুক্ত প্রার্থী দেননি বলে যা বলা হচ্ছে তার পেছনে তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। অবশ্য উপযুক্ত প্রার্থী দিলেও যে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট বিপ্লব হতো না তা কিন্তু নয়। তবে বিএনপির নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা বেড়ে হয়ত অনাধিক ৩০ জনে পৌঁছতে পারত। আমরা নির্বাচনের বহু আগেই জেনেছি দুর্নীতির শিরোমণি তারেক জিয়া তাদেরই নমিনেশন দিয়েছেন যারা তাকে অধিক উপঢৌকন দিতে পেরেছেন। এর ফলে তাদের দলের অনেক শক্তিশালী লোকই বাদ পড়ে গেছেন। এমন অনেককে নমিনেশন দেয়া হয়েছে জনগণের কাছে যাদের কোন পরিচিতিই নেই। ড. কামালের নেতৃত্ব ড. কামাল চিরদিনই অন্ধকারের লোক। কোনদিনই তিনি নিজ প্রচেষ্টায় নির্বাচিত হতে পারেননি। ’৭১-এ তার ভূমিকা ছিল রহস্যময়। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় এবং পরবর্তী সময়ে তার সন্দেহজনক অবস্থান এবং বিচরণের কারণে বঙ্গবন্ধুর অতি নিকটজন ড. ফরাসউদ্দিনসহ অনেক বিশিষ্টজন বঙ্গবন্ধু হত্যায় ড. কামালের ভূমিকা তদন্তের দাবি তুলেছেন। ড. কামাল নির্বাচনের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে এবং যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে জোট বেঁধে আবারও প্রমাণ করলেন যে ’৭১-এ তার ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। তিনি ঐক্য করলেন সেই দলের সঙ্গে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর খুনী, যে দলের নেতা গ্রেনেড দ্বারা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে খুন করতে চেয়েছিলেন। তিনি পুলিশ বাহিনীকে জানোয়ার বলে এবং সাংবাদিকদের পাকি ভাষায় ‘খামোশ’ বলে এবং দেখে নেয়ার ভয় দেখিয়ে ভোটারদের বুঝিয়ে দিলেন তার মতো কা-জ্ঞান বিবর্জিত এবং স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন লোক দেশের নেতৃত্ব নিতে পারেন না। তদুপরি তার ফ্রন্ট জিতলে কার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে এ ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাক থাকায় জনগণ তথাকথিত ঐক্যফ্রন্টকে আস্থায় নিতে পারেনি। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য এই ফ্রন্ট ভোট চেয়েছিলেন। তাদের ভোট না দিয়ে জনগণ বুঝিয়ে দিলেন তারা দুর্নীতিবাজ খালেদার মুক্তি চান না। লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×