ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ লাল পাহাড়ের দেশ ভ্রমণে

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ লাল পাহাড়ের দেশ ভ্রমণে

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুপাশে উঁচু-নিচু টিলা আর মাঝে মধ্যে দু-একটি ধানক্ষেত। এ যেন প্রকৃতির এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। রাস্তার দুপাশে আকাশচুম্বী গাছের সারি, চোখ জুড়ানো পাহাড় যেন সবুজের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। আমাদের বাস এগিয়ে চলছে, এগিয়ে চলছে আমাদের উৎসুক দৃষ্টি। বাসের জানালাগুলো একঝাক তরুণদের প্রকৃতির নির্মল বাতাস আর জীবনের ছন্দ দিতে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা ঘাসে তখনও সূর্যের আলো এসে পড়েনি। কুয়াশার চাদরে তখনও ঢেকে থাকা ছোট ছোট পাহাড়গুলোর আকর্ষণ উৎসুক দর্শকদের ঘুমাচ্ছন্ন ভাবগুলোকে এক নিমিষেই দূর করে দিয়েছে। বলছিলাম শেরপুর জেলার দর্শনীয় স্থান মধুটিলা ইকোপার্ক এবং গজনী অবকাশ কেন্দ্র ভ্রমণের গল্প। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা দুইটি বাস নিয়ে বার্ষিক শিক্ষাসফরে রওনা হই শেরপুরে। আমাদের ৮৫ জন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন বিভাগের দুজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক গৌতম দত্ত এবং ড. সুমাইয়া খানম। সারি সারি রাবার গাছের সমারোহ, ফলজ শাল, গজারি ও সেগুনবনের বিন্যাস অনায়েসেই প্রকৃতিপ্রেমীদের করে তুলতে পারে উদ্বেল। পাহাড়ী ঝরনা ও ঝোড়ার স্বচ্ছ জল হৃদয়ে তুলবে আনন্দের হিন্দোল। শুধু যে পাহাড়, বনাঞ্চল এবং ঝরনা রয়েছে তা নয়, এতসব প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে সৌন্দর্যের কৃত্রিম বাহার। এ এলাকাটি মূলত শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আমরা প্রথমে যাই বারমারী এলাকার খ্রীস্টান ধর্মীয় উপাসনালয়ে। তারপর সেখান থেকে একটু দূরে আমাদের কাক্সিক্ষত মধুটিলা ইকোপার্কে এবং গজনী অবকাশ কেন্দ্রে অবস্থান করি। আগে অনেক শুনেছি ওয়াচ টাওয়ারের গল্প, এবার উপরে উঠে দেখার পালা। উপরে উঠে পাহাড়ের চুড়া দেখার স্বাদ আমাদের তর সইছিল না। ওয়াচ টাওয়ারটির উচ্চতা প্রায় ৬৪ ফুট। যতই উপরে উঠেছি প্রকৃতি যেন তাদের কোলে তুলে নিচ্ছিল আমাদের। মনে হচ্ছিল সবুজ পাহাড়ের প্রকৃতি যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে উপভোগ করার জন্য। জনবসতিগুলো উপরে উঠতেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল প্রকৃতির বিশাল সমুদ্রে আমরা সবাই সাঁতার কাটছি। দূর থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের স্পর্শ আর অনুভূতি আমাদের শিহরিত করে তুলছিল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে ঘন শালবন, সেগুন, মেহগনি, মহুয়া আরও নাম না-জানা অনেক বৃক্ষ। যখন আমরা ওয়াচ টাওয়ারটির চুড়ায় উঠলাম তখন মনে আনন্দের হিল্লোল বইছিল। এমনিতেই সাহিত্যের ছাত্র আমরা। প্রকৃতির এমন দৃশ্য তরুণ মনে এনে দিচ্ছিল বাসন্তি রং। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পাগল হওয়ার দশা আমাদের। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল আমরা আকাশে মেঘের ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছি। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর ধানক্ষেত। উপর থেকে মনে হচ্ছিল কে যেন সবুজ আর টিয়া রঙের গালিচা পেতে রেখেছে। কখনও কখনও ওয়াচ টাওয়ারের বটগাছের তলায় হেলান দিয়ে দর্শনার্থীরা ছবি তুলছিল। বট গাছের পাশের চমৎকার একটি লেক বয়ে চলেছে। তিনটি ময়ূরপঙ্খী ভাসছে লেকটিতে। এ যেন পার্বত্য রাজাদের নৌবিহারের দৃশ্য। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের চুড়ায় বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ডায়নোসর, জিরাফ এবং হাতির কৃত্রিম প্রতিকৃতিগুলো। দূর থেকে যেকেউ প্রথমে আঁতকে উঠতে পারেন। এমন অনেক আঁতকানোর মতো দৃশ্য আছে এ পাহাড়ে। বৃহত্তম ময়মনসিংহের এ জেলাটিকে ঘিরে রেখেছে পুরনো ব্রহ্মপুত্র আর পাহাড়ী নদী ভোগাই, মহারশি, মারিজি, সোমেশ্বর এবং মৃগি। গজনী পাহাড়টি ঝিনাইগাতি উপজেলার সীমান্তবর্তী কাংশ ইউনিয়নে উপস্থিত। রাস্তার পাশেই বিজিবির ক্যাম্প সদস্যরা সীমান্ত পাহাড়া দিচ্ছিল। এই এলাকার আরেকটি নাম আছে যেটি ‘গারো পাহাড়’ নামে অধিক পরিচিত। আশপাশের বাড়িঘরগুলোই বলে দেয় এখানে আদিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশের বসবাস। হাজং, গারো, এবং কোচরাই এ অঞ্চলের প্রধান আদিবাসী। গজনী অবকাশ কেন্দ্রেই আমাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেন নালিতাবাড়ী উপজেলার নাজমুল সিদ্দিকী সরকারী কলেজের অধ্যাপক জিন্নাহ ভাই। এছাড়া সরকারী রেস্ট হাউসটিতে বিশ্রামের ব্যবস্থাও করেন। তিনি ছিলেন রাবির বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র। গজনী অবকাশ কেন্দ্রটিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে কিছু দর্শনীয় বিনোদন কেন্দ্র। প্রকৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির একটা মেলবন্ধন ঘটেছে স্থানটিতে। এখানে রয়েছে মৎস্যকন্যার ভাস্কর্য। মিষ্টি হাসিতে যেন পর্যটকদের গ্রহণ করছে সে। কিছুক্ষণ পর গেলাম চিত্রা হরিণের মিনি চিড়িয়াখানায়। আমরা স্থানটির পদ্মসিঁড়িতে কিছুক্ষণ হাঁটি। গজারি বন আর সবুজের নিবিড় সংমিশ্রণে যে কেউ হয়ে উঠবে কবি! এ যেন কবিতামালার বাগান! সবশেষ জিন্নাহ ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন লেকের মাঝখানে একটি দ্বীপে। যেটির নাম ‘লেকভিউ পেন্টাগন’। দ্বীপে যাওয়ার জন্য আছে স্টিলের একটি সেতু। এছাড়া রয়েছে কৃত্রিম সুরঙ্গ পথ ‘পাতালপুরী’। ক্রিসেন্ট লেকের মাঝখানে আছে কৃত্রিম ঝরনা ‘নির্ঝর’। আবার পশ্চিম পাহাড়ে আছে বর্ণিল সেতু ‘রংধনু’। সবগুলো স্থানেই আমরা বন্ধুরা মিলে বিভিন্নভাবে ছবি তুলি। এর আগে দুপুরে আমরা খাবার খাই। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পশ্চিম আকাশের সূর্য হলদে থেকে রক্তবর্ণ আকার ধারণ করতে থাকে। সেও বিদায় নিতে থাকে। আর আমাদের দেয় বিদায়ের বার্তা।
×