ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ

দখল হচ্ছে আন্ধারমানিক নদী

প্রকাশিত: ০৭:২১, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

দখল হচ্ছে আন্ধারমানিক নদী

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ৫ জানুয়ারি ॥ ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীতে কোন কিছুতেই থামছে না দখল দৌরাত্ম্য। একটি প্রভাবশালী মহল ফ্রি-স্টাইলে গিলে খাচ্ছে আন্ধারমানিকের তীরসহ নদী। প্রতিদিন তোলা স্থাপনার সংখ্যা বাড়ছে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্থাপনা তোলা হয়েছে কলাপাড়া পৌরশহর এলাকায়। বহুতলসহ পাকা-আধাপাকা টিনশেড স্থাপনা তোলা হচ্ছে আন্ধারমানিকের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায়। অধিকাংশ আন্ধারমানিকের উত্তর পাড়ে। দেখা গেছে, নাচনাপাড়া ফেরিঘাট থেকে ফিশারি পর্যন্ত এলাকায় আন্ধারমানিক নদী তীরসহ দখল করে তোলা হচ্ছে স্থাপনা। ফলে এই নদী সঙ্কুচিত হয়ে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমনিতেই পলিতে এক সময়ের খরস্রোতা আন্ধারমানিক এখন হারিয়ে ফেলছে স্বকীয়তা। দুই পাড়ে পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। আবার গোপনে এসব চর ভরাটের আগেই কেউ কেউ গোপনে চাষযোগ্য খাস কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত নিয়ে রাখছে। এছাড়া দূষণও চলছে ফ্রি-স্টাইলে। খোদ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলছে আন্ধারমানিকের লঞ্চঘাট এলাকায়। ফলে দূষণের কবলে পড়ে বিপর্যয় নেমে আসছে। এছাড়াও বালু ব্যবসায়ীদের দখলে রয়েছে হাইস্কুল সংলগ্ন এলাকা। প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্ধারমানিক এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। যেন যৌবন হারিয়ে ফেলছে। নদীর পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনজনিত ভরাটের কারণে উপকূলীয় কলাপাড়ার প্রধান এই নদীটি এখন নৌ-চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এক সময় আন্ধারমানিকের বুকে দোতলা লঞ্চসহ স্টিমার চলাচল করত। মালবোঝাই বিশাল আকৃতির কার্গোর চলাচল ছিল । মানুষ আন্ধারমানিকে চলাচল চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করত। বর্তমানে নদীটি তার চিরচেনা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। দীর্ঘ এলাকার দুই দিকে ছিল অসংখ্য শাখা নদী, ছোট-বড় খাল। এছাড়া শত শত স্লুইস খালও ছিল আন্ধারমানিক নদীর দুই পাড়ে। জোয়ার-ভাটার সময় প্রবল বেগে এসব শাখা নদী কিংবা খালে পূর্ণ জোয়ারের প্রবাহ বইত। আন্ধারমানিকের সঙ্গে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ছোট-বড় ভাড়ানির অন্তত ১২টি খাল ভরাট হয়ে গেছে। যেসব দিয়ে জোয়ারে ছোট ছোট নৌযান এখনও চলাচল করছে। কিন্তু ভাটার সময় বন্ধ থাকে। এসব সমস্যা ছাড়াও বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরের স্লুইস খাল ভরাট ও দখল হওয়ায় পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। আর এসব কারণে পলি পড়ে নদীর তলদেশ থেকে কিনার পর্যন্ত দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে। এখন প্রতি বছর অন্তত পাঁচ ফুট কমে যাচ্ছে নদীর প্রস্থ। এমনটাই দৃশ্যমান। এছাড়া নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এখানকার সচেতন প্রবীণ নাগরিকগণ মনে করেন, সাগরপারের এই জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্ধারমানিক নদী রক্ষায় এখনই সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নইলে মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি ইলিশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে আন্ধারমানিক নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় অন্তত সাতটি স্লুইস সংযুক্ত খাল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজের ক্ষেত্রেও। ওইসব স্লুইস সংযুক্ত নদীর সংযোগ খালটি বাইরে থেকে ভরাট হয়ে গেছে। ভাটার সময় পানি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকছে। নীলগঞ্জ, চাকামইয়া, তালতলীর চাউলাপাড়া, কড়ইবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রায় কুড়ি হাজার একর জমি চাষাবাদে ভয়াবহ সমস্যার আশঙ্কা করছেন কৃষক। ইলিশের অভয়াশ্রম এই নদীর রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। অন্য নদীর মতো একই গুরুত্ব বহন করে না। তাই এই নদী রক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দখল-দূষণ ঠেকাতে এখনই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ৪০ কিমি দীর্ঘ সাগর মোহনা পর্যন্ত এ নদীর নাব্য বজায় রাখার পাশাপাশি এ নদী পাড়ের স্থাপনা অপসারণ জরুরী। গেল বছর আবার নদীর পাড় ঘেঁষে স্থাপনা ছাড়াও অন্তত ১০টি ইটভাঁটি গড়ে উঠেছে। তাও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। মৎস্য অধিদফতর এই নদীতে অবৈধ জাল দিয়ে মৎস্য সম্পদ নিধন বন্ধে সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়া নবেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই তিন মাস এ নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এলাকার সব শ্রেণীর মানুষের দাবি কলাপাড়া একটি পর্যটন সমৃদ্ধ উপজেলা। আর এই উপজেলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আন্ধারমানিক নদী। এটি রক্ষা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ভরাট অংশ খনন করা প্রয়োজন। জেগে ওঠা চরকে জমি হিসেবে কেউ যেন দখল করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় আন্ধারমানিকের জেগে ওঠা চরে বনাঞ্চল সৃষ্টি করাও প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবশে সচেতনরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা’র) কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গেল বছরের মাঝামাঝি সময় স্থানীয় পর্যায়ের পরিবেশ ও উন্নয়নকর্মী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কলাপাড়ায় মতবিনিময় সভায় আন্ধারমানিক নদী রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি করেছেন। কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনুপ দাশ জানান, নদী-খাল কিংবা সরকারের খাস জমি উদ্ধারে দখলদার উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। এসব দখলদারও উচ্ছেদ করা হবে। রক্ষা করা হবে আন্ধারমানিক নদী।
×