ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পটুয়াখালীতে আমনের বাম্পার ফলন ॥ দামে অখুশি কৃষক

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

পটুয়াখালীতে আমনের বাম্পার ফলন ॥ দামে অখুশি কৃষক

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে এবারও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলায় ধানের উৎপাদন এতটাই বেড়েছে যে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরেও উদ্ধৃত্ত থাকবে অন্তত ৫০ ভাগ ধান। এরইমধ্যে ফসল কাটা প্রায় শেষের পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু জেলায় সরকারীভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান কেনা হচ্ছে না। ফলে বাজারে ধানের মূল্য অনেক কম। যে কারণে ধানের দাম নিয়ে জেলার কৃষক-চাষীরা অখুশি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছর পটুয়াখালী জেলায় ২ লাখ ২ হাজার ৬০৮ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ মেট্টিক টন। যা জেলার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরেও প্রায় ৫০ শতাংশ চাল উদ্ধৃত্ত থাকছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের হিসেব অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৫২৯ জন। এ জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্য প্রয়োজন তিন লাখ ৩৬ হাজার ৫০ মেট্রিক টন চাল। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরেও চাল উদ্ধৃত্ত থাকছে। এছাড়া গত অর্থ বছরে জেলায় আমন, আউশ ও বোরো উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৬২ মেট্টিক টন চাল। অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমনের বাম্পার ফলন হলেও সরকার এ জেলা থেকে পর্যাপ্ত চাল কিনছে না। ফলে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এ কারণে ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। আমন ধান উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় স্থানে পটুয়াখালী জেলা। কিন্তু তারপরেও জেলা থেকে সরকারীভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান-চাল কেনা হচ্ছে না। উপরন্তু জেলায় বছরে সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর জন্য যে পরিমাণ চালের প্রয়োজন, তাও সরকারীভাবে কেনা হচ্ছে না। আমদানি করতে হচ্ছে উত্তরাঞ্চল থেকে। অথচ এ অঞ্চল থেকে সরকার পর্যাপ্ত চাল কিনলে একদিকে চাল আমদানি বাবদ পরিবহন ব্যয় কোটি কোটি সরকারের সাশ্রয় হবে। অপরদিকে কৃষকও তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে। বর্তমানে কৃষকরা নতুন ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। তবে ধানের দাম নিয়ে কৃষক অত্যন্ত অখুশি। সরেজমিনে বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আমন ধান বিক্রি হতে দেখা গেছে। পটুয়াখালীর সদর উপজেলার হাজিরহাটে গিয়ে দেখা যায় প্রচুর ধান বিক্রির জন্য বাজারে উঠেছে। আসলাম ফকির নামে এক কৃষক জানান, এ বছর আমন ধান প্রতি মণ ৬১০ টাকা থেকে ৬৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকার পর্যাপ্ত ধান-চাল না কেনায় ফড়িয়ারা ধানের দাম কম দিচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকদের ৭০০ টাকা থেকে ৭২০ টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ বাজারে ধানের দর কম। উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়েও ধানের বাজারের একই চিত্র পাওয়া গেছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে উফশী ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ১৪ হাজার হেক্টর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৪.৫ টন থেকে ৫ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া, বড়বাইশদিয়া, চরমোন্তাজ ও চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নে প্রত্যাশার চেয়ে আমনের ভাল ফলন হয়েছে। মাঠ ভরা পাকা সোনালী ধানের মৌ-মৌ গন্ধে মাতোয়ারা কৃষক পরিবার। তবে ধানের বাজার দর কম থাকায় তারা বেজায় অখুশি। ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের উত্তর চতলাখালী গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলামের বলেন, এই বছর আমন ধান ভাল ওইছে (হয়েছে)। কিন্তু বাজারে দাম নাই। শেষ পর্যন্ত যদি দাম না উডে (বাড়ে) তাহলে লোকসানতো ওবেই (হবে)। কৃষক আলী আহম্মেদ বলেন, এক মণ ধান উৎপাদন করতে বীজ, সার, কীটনাশকসহ বাজারে বিক্রি পর্যন্ত ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বর্তমানে এক মণ ধানের বাজারদর ৫৫০-৬০০ টাকা। তাহলে ধান লাগিয়ে লাভ কি ? যা খরচ হয়, তাই তো ওঠে না। স্থানীয় কৃষক ও ধান ব্যবসায়ীরা জানান, মাঠের ফলন দেখে কৃষকরা খুশি হয়েছিল। কিন্তু বাজারদর দেখে ততটাই হতাশ হয়েছে। বহু কৃষক ঋণ কিংবা ধার দেনা করে ধান আবাদ করেছে। সে দেনার বোঝা হালকা করতে কম দামেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মোঃ আব্দুল মন্নান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকা এবং কৃষি বিভাগের তৎপরতা থাকায় এ মৌসুমে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। ধানের দাম কম থাকায় আমরাও চিন্তিত। তবে দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই ধানের দাম বেড়ে যাবে। এদিকে, জেলা কৃষি কৃষি বিভাগ সূত্র জানায় সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিসে কর্মরতসহ ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএসসহ সরকারের বিশেষ প্রকল্পে জেলায় চালের চাহিদা ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সরকার পটুয়াখালী জেলা থেকে আমন চাল সংগ্রহ করেছিল ৪ হাজার ৩৭৪ মেট্টিক টন এবং বোরো চাল ৯ হাজার ৪৫৭ মেট্টিক টন। অর্থাৎ মোট ১৩ হাজার ৮৩ মেট্টিকটন চাল সরকার সংগ্রহ করেছিল। বাকি ২২ হাজার ১৬৯ মেট্টিক টন চাল উত্তরাঞ্চল থেকে পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমে এসেছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গোডাউন থেকে ট্রাকে চাল আমদানি করা হয়। চাল আমদানিতে পরিবহন ব্যয় ও ঘাটতি বাবদ প্রতি কেজিতে ৩ টাকা ব্যয় হয়। এ হিসেবে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অথচ এ চাল এ অঞ্চল থেকে কেনা হলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো এবং কৃষকরাও তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পেত। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হৃদয়েশ্বর দত্ত বলেন, আমন উৎপাদনে পটুয়াখালী জেলা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ বছরও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমন চালে খাদ্যমান বেশি, সংরক্ষণ সুবিধা ও গ্রাহকের চাহিদা বেশি। সরকারীভাবে এ অঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য সংগ্রহ করলে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) বিএম শফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর জেলা থেকে ৯ হাজার ৪০৮ মেট্টিক টন আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ধান উৎপাদন অনুযায়ী সরকারীভাবে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলে উত্তরাঞ্চল থেকে চাল আমদানি করতে হবে না এবং সরকারের পরিবহন ব্যয় অনেক কমে যাবে। পাশাপাশি কৃষকরাও তাদের ধান ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে লাভবান হবে।
×