ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং  কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

৪ জানুয়ারি ছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী চিরতরুণ এ ছাত্র-সংগঠনটি ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে এ বছর। ৭১, বাঙালীর কাছে শুধু সংখ্যা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাতির স্বাধীনতা, পতাকা ও মানচিত্রের আবেগতাড়িত মহা-কাব্যকথা। ’৭১ মানেই বাঙালী জাতির স্বপ্নপূরণ। আর এই স্বপ্ন-পূরণে যে ছাত্র-সংগঠন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ও নেতৃত্বে আদ্যোপান্ত কা-ারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সংগঠনটির ৭১তম জন্মদিন, আমাকে একজন বাঙালী হিসেবে আবেগপরায়ণ করে তোলে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, এক স্বপ্ন-সাহসের নাম; স্বপ্নপূরণের নাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের নাম। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে ভারত উপমহাদেশে শুধু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল যোজন যোজন মাইল, মাঝখানে ছিল ভারত নামক বিশাল রাষ্ট্রটি। বাঙালী জাতিসত্তার মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ নেতা। দেশ ভাগের পর, প্রথম থেকেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈরী, বৈষম্য ও কর্তৃত্ববাদী আচরণে; বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদর্শী বিচক্ষণতায় বুঝতে পেরেছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে বাঙালী জাতির স্বাধিকার আদায়ে শিক্ষিত, তরুণ তুর্কী ছাত্রদের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান, ২০০৭ এর ১/১১ এর সেনা-সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনসহ বাংলাদেশের যেকোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই ছাত্র-সংগঠনটি। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই কালজয়ী ছাত্র সংগঠনের ১৭ হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। বোধ করি, মাতৃভূমির জন্য পৃথিবীর আর কোন ছাত্রসংগঠন এতটা ত্যাগ করেনি। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ৭১ বছরে এই ছাত্র-সংগঠনের অনেক ঐতিহাসিক সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি অনুপ্রবেশকারী ও কিছু বিপথগামী কর্মীদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনার দায়ভারও অনেক সময় নিতে হয়েছে। ২৯তম সম্মেলনের পর অবধারিতভাবে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। বলা হচ্ছে, সংগঠনের সাংগঠনিক নেত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবার নতুনভাবে ছাত্রলীগকে সাজাবেন। যদি তা হয়, তবে সত্যি ছাত্রলীগের জন্য আশার, আশীর্বাদস্বরূপ। এই যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। এই সংগঠনের একজন সাবেক সামান্য কর্মী হিসেবে নতুন নেতৃত্ব-কেন্দ্রিক মোটা দাগে কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। ক. সর্বপ্রথম, নেতৃত্বে যারা এসেছেন বা আসবেন তাদের নিয়মিত ছাত্রত্বের পাশাপাশি মুজিব-আদর্শ, মুজিববাদ ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে চিন্তা, চেতনা ও কর্মে লালনের প্রমাণ অতীব জরুরী। সঙ্গে জরুরী পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড। অগ্রাধিকার দিতে হবে ছাত্র রাজনীতির বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসা ত্যাগী পোড়-খাওয়া ছাত্রনেতাদের। নেতৃত্বে যারা আসবেন, তাদের যেমন হতে হবে মেধাবী নিয়মিত ছাত্র, অনলবর্ষী বক্তা, রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা; তেমনি সময়কে ধারণ করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও দলীয় তৃণমূলের নেতা কর্মীদের পালস বুঝার ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। খ. জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য নিয়মিত পাঠচক্রের মতো একটা জরুরী বিষয় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেটা, নিকট অতীতে সোহাগ-নাজমুল কমিটির সময় চালু ছিল। জাতির জনকের জীবনীকে অবশ্যপাঠ্য রেখে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র দর্শনের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এই পাঠচক্রে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে। একটি আধুনিক ও ডিজিটাল লাইব্রেরী করে বইয়ের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাতে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবে। গ. প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থ বুঝে সে মোতাবেক কাজ করতে হবে। আজকের বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লবের যে শুভ সূচনা হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় পড়ালেখা ও রাজনীতির পাশাপাশি ছাত্রলীগকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে একটি কর্মদক্ষ, ডিজিটাল ছাত্র সংগঠনে রূপান্তর করা যেতে পারে। দুঃখের ব্যাপার হলো, সারা বাংলাদেশ যতটা ডিজিটাল হয়েছে, ছাত্রলীগ ততটা হয়নি। যদিও, এখনকার শীর্ষ নেতৃত্ব গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বিরাট কর্মযজ্ঞে, ভলান্টিয়ারলি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সেবা বা কাজ নিশ্চিত করা যেতে পারে। এতে তিনটি সুফল আসবে- ১. প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করা যাবে। ২. ছাত্ররাজনীতির পাঠ শেষে সংগঠনের কর্মীরা নিজেদের ‘স্টার্ট আপ’ বিজনেস শুরু করতে বা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে। ফলে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বেকারত্বের বোঝা লাঘব হবে। ৩. জনমনে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। ঘ. বিভিন্ন বিশেষায়িত কমিটিগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন, চিকিৎসাবিজ্ঞান শাখা ছাত্রলীগ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, বুয়েট ছাত্রলীগকে জনগণের কাছে পাঠিয়ে পরামর্শ ও সেবামূলক কাজে ভলান্টিয়ার ওয়ার্ক করানো যেতে পারে। এতে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। সমস্যা নিরূপণ করে সমাধান সহজ হবে। ঙ. প্রত্যেক রাষ্ট্র, সমাজ বা সংগঠনের উন্নয়নের পিছনে রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জ্উ) সেল এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ ছাত্রলীগকেও একটি সেল তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার ডাটা সংরক্ষণ এবং এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নীতি প্রণয়নে ও তৎ-ব্যবস্থার কর্মপন্থা ও উন্নয়নে সহায়ক বা ছায়া ভূমিকা পালন করতে পারবে। এবং রাজনৈতিক প্রচারে ও প্রতিপক্ষের অপপ্রচার মোকাবেলায় এ- সেল যুক্তিসঙ্গত সাহায্য করবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আতুর ঘর থেকে আমার রাজনৈতিক জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার আত্মা ও সত্তার সঙ্গে মিশে আছে এ সংগঠন। সর্বোপরি, আমার, ‘আমি’ হয়ে ওঠা। সংগঠনের সফলতা ও যোগ্যতম নতুন নেতৃত্বের প্রত্যাশা করছি। শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। লেখক : টোকিও মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটিতে মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত
×