ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও পুলিশ খুঁজেই পাচ্ছে না

দলীয় কার্যালয়ে রিজভীর মাসের পর মাস রহস্যময় অবস্থান

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

দলীয় কার্যালয়ে রিজভীর মাসের পর মাস রহস্যময় অবস্থান

শংকর কুমার দে ॥ কোন রাজনৈতিক দলের অফিসে প্রায় এক বছর ধরে অবস্থান করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী। তাও আবার ফৌজদারি মামলার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে অবস্থান করছেন তিনি। পুলিশের খাতায় তিনি ওয়ান্টেড। কিন্তু তাকে নাকি খুঁজেই পাচ্ছে না পুলিশ। রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসে বসে তার প্রতিদিনের রুটিন কাজ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ করে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ। ফৌজদারি মামলার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক অফিসে রিজভী ছাড়া এত দীর্ঘকাল অবস্থানের রেকর্ড আর কোন রাজনীতিকের নেই। ২০১৮ সালের প্রায় পুরোটাই দলীয় অফিসে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। রিজভীর দলীয় অফিসে রহস্যময় নাটকের এই পরিকল্পনার নেপথ্যের কোন কারণ অনুসন্ধান করেও খুঁজে পাচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থা। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ২০১৮ সালের পুরো এক বছর ধরে টানা অবস্থান করার ঘটনাই তার প্রথম নয়। এর আগের বছর ২০১৭ সালে অন্তত দুই বার দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেছিলেন তিনি। রাজধানীর নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়টির তিন তলায় রীতিমতো তার বাড়ি ঘর বানিয়ে অবস্থান করছেন। রীতিমতো ভিআইপিদের রেস্ট হাউস। তার থাকার জন্য খাটিয়া, রান্না-বান্নার জন্য ব্যবস্থা, সংবাদ সম্মেলন করার জন্য লোকজন, নেতাকর্মীর সমাগম ঘটাচ্ছেন। কি নেই সেখানে? এবার তিনি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিকে নিজের নিরাপদ নিষ্কণ্টক বাসভবন বানিয়েই আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের বিষোদগার করে চলছেন প্রতিদিনই, যেন এটাই তার দৈনন্দিন রুটিন কাজ। তবে মাঝে মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করে আবার দলীয় অফিসে ফিরে আসার নজিরও আছে। দলীয় অফিসে বসে তিনি কোন গোপন পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রিজভীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর বিদায়ী বছর ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় এক বছর ধরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন তিনি। রমজান, ঈদ, ধর্মীয় দিন, নানা অনুষ্ঠানের দিনেও দলীয় অফিসেই কাটিয়ে দিচ্ছেন রিজভী। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানই বা করছেন কি করে এবং প্রতিদিনই একের পর এক অভিযোগ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিভাবে? প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্র্যালয়ে অবস্থান, প্রায় প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্যদান- যা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পরও পুলিশ তাকে নাকি খুঁজেই পাচ্ছে না। দলীয় অফিসে বসেই বিগত বছরে আগুন সন্ত্রাস, নাশকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ করেছে পুলিশ তার বিরুদ্ধে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পল্টনের বিএনপি অফিসে অবস্থান করার রহস্যাবৃত নাটক নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রিজভী বিদায়ী বছর ২০১৮ সালের পুরোটাই বিএনপি অফিসে অবস্থান করে কাটিয়ে দেয়ার ঘটনা ছাড়াও এর আগে ২০১৩ সালে টানা ৫২ দিন-রাত পার্টি অফিসে অবস্থান করেছেন। টানা ৫২ দিন পার্টি অফিসে অবস্থান করার পরও আরেকবার পার্টি অফিসে অবস্থান করে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। সে সময় রিজভী নাটকে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। হঠাৎ করে রাতের বেলায় পল্টন অফিসে হাজির হন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তখন ছাত্র দলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন আহাম্মেদ টুকু প্রায় অর্ধশত মামলার আসামি হয়ে কর্তব্যরত পুলিশের গাড়ির বহরে তার গাড়ি তুলে দিয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা আহত হওয়ার ঘটনায় টুকুকে আটক করার পর তাকে জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বাহিনী সিএসএফ-এর সদস্যরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছিল। রিজভীর পার্টি অফিসে অবস্থান করার ঘটনা নিয়ে অতীতে ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কারণেই আবারও তার পার্টি অফিসে অবস্থানের প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনাটির উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বার বার নাটকের জন্ম দিচ্ছেন রুহুল কবির রিজভী। যখনই তিনি নয়াপল্টনের বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেন তখনই একটা না একটা অনাক্সিক্ষত বা অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কোন রাজনৈতিক নেতা কোন পার্টি অফিসে অবস্থান করার এতদিনের রেকর্ড কোথাও পাওয়া যায়নি। পার্টি অফিসে অবস্থান করার বিষয়ে তার দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে। হয়রানি, নির্যাতনের ভয়ে পার্টি অফিসে অবস্থান করছেন তিনি। পার্টি অফিসে অবস্থান করার পর বার বার নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন তিনি। পার্টি অফিস থেকে তাকে গ্রেফতার করা হলে, পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ভাবমূর্তিও সৃষ্টি হতে পারে- এমন ধারণা থেকেই কি পার্টি অফিসে অবস্থান করছেন? দেশ-বিদেশে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে নানা ধরনের মন্তব্য করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরব হবে, হৈচৈ শুরু করবে। নিজ রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কাছে ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যাবে। কারাবন্দী সাজাপ্রাপ্ত দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, লন্ডনে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার প্রতি সদয় হবেন এমন আশায় তিনি দলীয় অফিসে অবস্থান করে রেকর্ড সৃষ্টি করছেন, যাতে পরবর্তীতে দলের কাছে সমাদৃত হতে পারেন, পদ পদবির সুবিধা, আনুকুল্য লাভ করতে পারেন। সবচেয়ে নগদ লাভ হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার পাওয়ার সুযোগ ঘটছে তার। রিজভী নাটকে যেসব নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাওয়া ছাড়াও পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, তার এই অবস্থান গোপন কোন পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে, যা রহস্যজনক।
×