ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়

রাস্তার ধারে গরম গরম ভাপা চিতই, ফুঁ দিয়ে খাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

রাস্তার ধারে গরম গরম ভাপা চিতই, ফুঁ দিয়ে খাওয়া

মোরসালিন মিজান ॥ অফিস আদালত সব খোলা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। এ অবস্থায় অনেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। শীত বেড়েছে। পৌষের শীত। গ্রামের বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে পিঠাপুলির আয়োজন। মা ঘন ঘন ফোন করে জানতে চাইছেন, কবে আসবি খোকা? খোকা এখন বড়। নিজের ঘর সংসার আছে। নয়টা-পাঁচটা অফিস। এর পরও গ্রামে যাওয়ার জন্য অস্থির। সুযোগ পাওয়ামাত্রই চলে যাচ্ছে। মায়ের হাতে বানানো পিঠা খাচ্ছে মজা করে। কথার কথা নয়। পরিচিত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল এমন তথ্য। শুধু পিঠা খাওয়ার জন্য ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছেন তারা। অনুপম নামের একজন এখন কুষ্টিয়ায়। মুঠোফোনে তিনি বলছিলেন, পৌষ মানেই গ্রামের বাড়ি। মায়ের হাতের পিঠা। কিন্তু এবার বউ বাচ্চার সিডিউল মিলছিল না। তাই একলা চলে এসেছি। ইতোমধ্যে প্রচুর পিঠা খাওয়া হয়েছে। ঢাকায় ফেরার সময় স্ত্রী সন্তানদের জন্য পিঠা নিয়ে আসবেন বলেও জানান তিনি। কিন্তু যারা গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন, বেশিরভাগই বিচ্ছিন্ন আসলে, তারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। বাসায় নিজেরা পিঠা পুলি করে খাবেন? অভ্যাস নেই। সময়ইবা কোথায়? অগত্যা ঢাকার অস্থায়ী দোকানগুলোতে ভিড় করছেন তারা। এখন ঢাকার প্রায় সব রাস্তার ধারে পিঠার দোকান। বিকেল হতেই চুলো বসে যাচ্ছে। সকালেও বিক্রি করছেন কেউ কেউ। চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে পিঠা। পিঠা বলতে ভাপা আর চিতই। মাত্র দুই প্রকার। তাতে কী, প্রতিটি দোকান ঘিরে ছোটখাটো উৎসব। চাহিদা বেশি হওয়ায় সারা বছর যারা অন্য ব্যবসা করেন, তারাও এখন পিঠা বানানোর কাজে ব্যস্ত। বরাবরের মতোই পৌষের পিঠা উৎসব বিশেষ দৃশ্যমান হচ্ছে টিএসসি এলাকায়। শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অল্প জায়গা ঘিরে ২০টির মতো দোকান। দোকান মানে, অস্থায়ী চুলো পেতে পিঠা তৈরি ও বিক্রির ব্যবস্থা। আগেই বাসা থেকে চালের গুঁড়ি প্রস্তুত করে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে খেজুরের গুড়, নারকেল। চুলো জ্বলছে। চুলোর ওপর পানি ভর্তি পাতিল। কয়েকটি ছিদ্র বিশিষ্ট ঢাকনা পাতিলের মুখে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তার পর সেখানে চালের গুঁড়ি ভর্তি ছোট বাটি পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে উপুড় করে ঢেলে দেয়া হচ্ছে। বাটি উঠিয়ে নিতেই কাপড়ের উপর দৃশ্যমান হচ্ছে ভাপা পিঠাটি। কী যে ভাল লাগে দেখতে! একই দোকানের অন্য চুলোয় হচ্ছে চিতই। এ জন্য চালের গুঁড়ি গুলিয়ে এক ধরনের সাদা তরল তৈরি করা হয়েছে। পরে তা বড় গোল চামচে নিয়ে শুকনো গরম কড়াইয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অমনি হয়ে যাচ্ছে চিতই পিঠা। এই পিঠা খাওয়ার আদি পদ্ধতি হচ্ছে, শুঁটকি ভর্তা দিয়ে খাওয়া। যারা খেতে পারেন, তারা একাধিকবার ভর্তা চেয়ে নিচ্ছিলেন। একইভাবে গরম ভাপা পিঠা চুলো থেকে নামিয়ে প্লাস্টিকের ছোট পাতলা পিরিচে তুলে দেয়া হচ্ছিল। হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছিল মাঝের এক দাঁত ভাঙ্গা কাঁটা চামচ। চামচে কেটে নিয়ে ফুঁ দিয়ে খাচ্ছিলেন সবাই। মুখে এক টুকরো পুরে দিয়ে কিছু সময় হা করে থাকছিলেন। এভাবে পিঠা ঠান্ডা হলে পরে চালান করে দিচ্ছিলেন ভেতরে। টিএসসিতে প্রবেশের মুখেই দু’টি দোকান। হাতের বামে একটি। অন্যটি ডানে। ডানের দোকানটি কণা’র। একেবারে ছোট থেকে এখানে পিঠা তৈরির কাজ করছে সে। পরিচিত মুখ। এখন কলেজ পড়ুয়া। বদরুন্নেসা কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। দিনের বেলায় ক্লাস। অনুপস্থিতির সময়টুকুতে পিঠা তৈরির কাজ করে তার ভাই মনির। মনির জানায়, সে শুধু ভাপা তৈরি করতে পারে। কণা আসার পর পাওয়া যায় চিতইও। চিতইয়ের পাশাপাশি ঝালভাপা তৈরি করে সে। ঝালভাপার বর্ণনা দিয়ে কণা বলে, এই ভাপা পিঠায় কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি মেশানো হয়। স্বাদটা বদলে ঝাল হয়ে যায় বলেই ঝালভাপা নাম। নতুন উদ্ভাবন বটে। বিক্রিও ভাল। প্রতিটি পিঠা ১০টাকা করে বিক্রি হয় বলে জানায় কণা। এর ঠিক উল্টো দিকে সেলিমের দোকান। সেখানেও তৈরি হচ্ছে ভাপা এবং চিতই। বিকেলে বিক্রি অল্প বলেই মনে হলো। সন্ধ্যা হতেই ভিড় বেড়ে যায়। সেলিম জানান, প্রতি বছর শীতে এখানে পিঠার দোকান চালু করেন তিনি। কিছু লোকও রেখে দিয়েছেন। তারাও কাজ করছেন। এভাবে বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে পিঠা বিক্রি। এ সময়ের মধ্যে কয়েকশ পিঠা বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। এক হিসাব বলছে, টিএসসি এলাকার ২০ দোকানে প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ৩ হাজার পিঠা তৈরি হয়! খাওয়াও হয় এখানেই। আরিফ নামের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, শীতটা বাড়ার পর থেকেই পিঠা খাওয়ার লোভ হচ্ছিল। গ্রামের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। তাই এখানে এসে কিনে খাচ্ছি। এই খাওয়ার সঙ্গে মায়ের হাতের পিঠার কোন মিল নেই। কিন্তু স্মৃতিটা উস্কে দেয়। শহীদ মিলন চত্বর সংলগ্ন রাস্তার ধারে আবার আধুনিক পরিবেশনা। বেইলি রোডের পিঠার দোকান থেকে পিঠা এনে এখানে বিক্রি করা হচ্ছে। শুধু ভাপা-চিতই নয়, পাটিশাপটা, নকশি পিঠাসহ আরও অনেক প্রকার পিঠা। পাতলা পলিথিনে আড়াল করে রাখা পিঠার দাম অন্যগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। তিনগুণ। এখানে ভিড় একটু কম হলেও, বিক্রি মন্দ নয়। ভিন্নতার স্বাদ নিতে বিভিন্ন নামের পিঠা কিনে খাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারও আগে সকালে সেগুনবাগিচা এলাকায় দেখা যায়, রাস্তার ধারে চুলো পেতে পিঠা তৈরি করছে ফুল মিয়া ও গুলবাহার দম্পতি। মূল বাড়ি হবিগঞ্জে। অন্য সময় পান বিক্রি করেন। এখন স্ত্রী ভাপা ও চিতই পিঠা তৈরি করছেন। আর স্বামী চুলোর আগুন ঠিক রাখার কাজে ব্যস্ত। ফুল মিয়া বলছিলেন, সকালে অনেকে পিঠা দিয়ে নাস্তা করেন। এ কারণেই সকাল সকাল দোকান নিয়ে বসা। গুলবাহার কিছুটা স্মৃতিতে ফিরে যান। বলেন, গ্রামে নিজের ছেলে মেয়েদের জন্য পিঠা করতাম। এখন শহরের মানুষদের জন্য করি। কাস্টমার যখন মজা করে পিঠা খায় তখন মনে একটা আনন্দ হয় বলে জানান তিনি। কিন্তু শুধু ভাপা আর চিতই কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই এগুলোই বানায়। তাছাড়া চিতই বা ভাপা রাস্তায় বসে সহজেই বানানো যায়। তেলও লাগে না। এসব কারণে ভাপা এবং চিতই নাগরিক সমাজে বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠেছে। এদিকে, শীত শুরুর পর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বাংলা একাডেমিতে এবারও আয়োজন করা হবে পৌষ মেলার। গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলায় সব ধরনের পিঠা পাওয়া যাবে। শিল্পকলা একাডেমিতেও একাধিক পিঠা উৎসব আয়োজনের কথা রয়েছে। তার মানে পিঠা খাওয়ার সুযোগ এখনও আছে। সুযোগ কেউ মিস করবেন না যেন!
×