ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনে তথাকথিত অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে

বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর এ নির্বাচনের তথাকথিত অনিয়মের চিত্র তুলে ধরতে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে বিএনপি। একে একে ঢাকায় নিযুক্ত সব দেশের রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও এ অনিয়মের চিত্র তুলে ধরবে বিএনপি। এ জন্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সিনিয়র নেতাদের একটি টিম কাজ করছে। জানা যায়, সারাদেশে নির্বাচনে অনিয়মের কিছু তথ্য-প্রমাণ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে বিএনপি। এতে নির্বাচনের দিন দলের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে থাকতে না দেয়া, ব্যালট পেপারে সিল মারা, বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা এবং প্রার্থীসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলাসহ বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যেই মির্জা ফখরুল মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সঙ্গে সাক্ষাত করে তার কাছে ডকুমেন্টারিটি দিয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষে কাজ করার জন্য যাদের লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই লবিস্টের জন্য নতুন চুক্তির বিষয়েও কথা হয়েছে। তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করলেও বিএনপি সংসদে যাবে কি না জানতে চেয়েছে। পর্যায়ক্রমে নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারিটি ঢাকায় কর্মরত অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছেও পৌঁছানো হবে। এ ছাড়া জাতিসংঘ ও কমনওয়েল্থসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পৌঁছানো হবে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন সারাদেশের সবক’টি সংসদীয় আসনের অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হবে। দেশের মানুষের কাছেও আমরা তা উপস্থাপন করব। এর ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিভাবে ভোট কারচুপি করা হয়েছে। ৩ জানুয়ারি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সব প্রার্থীকে ডেকে এ নির্বাচনের অনিয়ম-কারচুপি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রার্থীদের নিয়ে বৈঠককালে সকল অনিয়ম কারচুপির তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। ভোট কারচুপির তথ্য-প্রমাণ নিয়ে বৈঠক শেষে ওইদিনই নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশনে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের এই স্মারকলিপি আইনসম্মত নয় বলে এটিকে আমলে নেয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করা প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাসদ সভাপতি আসম আবদুর রব সাংবাদিকদের জানান, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যাওয়া হবে। আর এ জন্যই সব অনিয়ম-কারচুপি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে অর্থাৎ গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই তার মুক্তি ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আন্তর্জাতিক লবিং জোরদার করতে থাকে বিএনপি। এ জন্য ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সহযোগিতা কামনার পাশাপাশি বিদেশে দৌড়ঝাঁপ ও দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চিঠি চালাচালি করা হয়। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি চালাচালি শুরু করা হয় দলের পক্ষ থেকে। খোদ মির্জা ফখরুল ইসলাম জাতিসংঘ সদর দফতর ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও একাদশ জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার বিষয়ে সহযোগিতা চান। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করা ও এ দলটিকে নিয়ে নির্বাচনী জোট করায় এ বিষয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পায়নি বিএনপি। নির্বাচনে ভারাডুবির পর আবারও নতুন উদ্যমে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়া শুরু করেছে দলটি। তবে এবার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি অভিযোগ তুলে দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করে বিদেশীদের সহযোগিতা চাচ্ছে। তবে ইতোমধ্যেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার ও দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বার্তা পাঠানোর কারণে বিএনপি যে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিয়ে তেমন সুবিধা পাবে না তা বলতে শুরু করেছে অভিজ্ঞ মহল। সূত্র মতে, বিএনপি অতীতে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াওসহ নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে বিদেশী কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন না পাওয়ায় খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পারও বিএনপিকে সহযোহিতা করতে এগিয়ে আসেনি বিদেশীরা। তবে এবারের নির্বাচনে ভরাডুবির পর এ নির্বাচনের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য সংবলিত ডকুমেন্টারি তৈরি করে তা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদেশীদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে এ যাত্রায়ও তাদের এ চেষ্টায় সফল না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ দেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। আর খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে। জানা যায় আগের মতো এবারও মির্জা ফখরুল, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ ক’জন সিনিয়র নেতা ও ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং নতুন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনসহ আরও ক’জনের তৎপরতায় বিএনপি বিদেশীদের সহযোগিতা পেতে সক্রিয় রয়েছে। তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। উল্লেখ্য, বছর দু’য়েক আগে খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’ চূড়ান্ত করার আগে ক’জন বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গেও এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। সে সময় এ ভিশন সম্পর্কে কূটনীতিকরাও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। পরে দলের পক্ষ থেকে ‘ভিশন -২০৩০’ ঘোষণার দিন উপস্থিত থাকতে ঢাকায় অবস্থানরত সব ক’টি দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বেশ ক’টি দেশের কূটনীতিক ওয়েস্টিন হোটেলে উপস্থিত ছিলেন। ‘ভিশন-২০৩০’ এর কপি সব দেশের দূতাবাসে পাঠানো হয়। এর পর থেকে বিএনপি কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। কিন্তু বিএনপির পক্ষে আন্তর্জাতিক লবিংয়ে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের আন্দোলন। কারণ ওই আন্দোলনকে দেশী-বিদেশী কেউ ভালভাবে নিতে পারেনি। আর এ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়েন খালেদা জিয়া। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের ভবিষ্যত করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় তারা দলের জন্য সুবিধা আদায় করতে আন্দোলনের পরিবর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকেই বিএনপির কিছু নেতা দেশে বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে সক্রিয় হন। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, একতরফা নির্বাচনের পর দেশে এখন গণতন্ত্রের সঙ্কট চলছে। এ অবস্থার অবসানে বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া দোষের কিছু নয়।
×