ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণফোরামের সংসদে যাওয়ার ইঙ্গিত ॥ বাদ কেবল বিএনপি

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

গণফোরামের সংসদে যাওয়ার ইঙ্গিত ॥ বাদ কেবল বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নির্বাচনের পর দলের নির্বাচিত সাংসদদের শপথ গ্রহণ ইস্যুতে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরই বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় তাদের বিজয়ী প্রার্থীরা শপথ নেবেন না। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও সর্বশেষ গণফোরাম থেকে বিজয়ী দুজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিচ্ছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন। অর্থাৎ বিএনপিকে রেখেই সংসদে যাচ্ছে কামাল হোসেনের গণফোরাম। শনিবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভার পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, গণফোরাম থেকে নির্বাচিতদের শপথ নেয়ার বিষয়টি ‘ইতিবাচক’ দৃষ্টিতে দেখছেন এবং ‘ইতিবাচক’ সিদ্ধান্ত নেবেন। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তোলার পর তাদের জোট থেকে বিজয়ীদের শপথ নেয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিসহ তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের সবাই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেও উপস্থিত ছিলেন না ঐক্যফ্রন্ট থেকে ভোটে বিজয়ী বিএনপির পাঁচ এবং গণফোরামের দুজন। বিএনপি মহাসচিবও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিন সরাসরি বলেছিলেন, শপথ তো পার হয়ে গেছে, প্রত্যাখ্যান করলে শপথ থাকে নাকি আর?... আমরা শপথ নিচ্ছি না, পরিষ্কার করে বললাম। তার দুদিন পর শনিবার গণফোরামের এক বৈঠকের পরে তোপখানা সড়কে শিশুকল্যাণ পরিষদের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এসে ভিন্ন কথা শোনালেন দলটির সভাপতি কামাল। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুজন শপথ নিচ্ছেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছি। যে দুজন প্রার্থী নির্বাচনে তারা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা তাদের বিষয়ে ইতিবাচকভাবে সিদ্ধান্ত নেব। গণফোরাম থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে জয়ী হয়েছেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। সিলেট-২ আসনে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে জয়ী গণফোরামের উদীয়মান সূর্য প্রতীক নিয়ে মুকাব্বির খান ভোটে অংশ নেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, বিএনপি যেহেতু শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের প্রতীকে ভোট করে গণফোরাম সদস্য শপথ নিলে তা দুই দলের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করবে কি না? উত্তরে কামাল বলেন, আমার মনে হয় না। সংবাদ সম্মেলনে সুলতান মনসুরও ছিলেন। সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিকসহ গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন। আওয়ামী লীগের এক সময়ের নেতা কামাল এবার বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটের লড়াইয়ে এলেও শুরু থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। জোট গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা মির্জা ফখরুল বললেও কামাল বলেছিলেন, দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। পরে ৭ দফা দাবি পূরণে নির্বাচন কমিশনের আশ্বাসে কামাল আশ্বস্ত হওয়ার কথা জানালেও বিএনপির মহাসচিবের কথায় ছিল ভিন্ন সুর। তবে ভোটের পর দুজনে একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এসে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলেন। বৃহস্পতিবার জোটের নেতারা একসঙ্গে ইসিতে গিয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার দুই দিনের মধ্যে ফখরুলসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের একাংশের নোয়াখালী সফরে থাকার মধ্যে শপথ নেয়া নিয়ে কামালের ভিন্ন কথা শোনা গেল। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে বিএনপি এবারই সবচেয়ে কম আসনে জয়ী হয়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে তাদের আসন মাত্র ৫টি। অন্যদিকে দুই যুগ আগে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে কামাল গণফোরাম গঠনের পর এবারই প্রথম দলটি থেকে কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। তবে দল প্রধান হিসেবে কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ নেননি। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিজয়ীদের শপথ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে কামাল হোসেন বলেন, বছরের শুরুতে একটা নির্বাচন হয়েছে, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কোন খেয়াল খুশির ব্যাপার না। সংবিধানে এ ব্যাপারে বক্তব্য আছে। নির্বাচন হতে হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। জনগণের মালিকানা যেন এখানে থাকে। তারা মালিক হিসাবে যেন তাদের প্রতিনিধি ঠিক মতো নির্বাচিত করতে পারে। ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে, দেশের অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনকে কত রকমের আঘাত দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত হলো প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন। সেখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে তো প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র হয় না। তিনি বলেন, জনগণ যদি ঠিকমতো ভোট দিতে পারে, তাহলে তারা তাদের মালিকানা ভোগ করতে পারে। নিরপেক্ষ ও কার্যকরভাবে যদি ভোট দিতে পারে, তাদের ভোট দেয়ার পদ্ধতির ওপরে যদি আঘাত দেয়া হয়, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিধানগুলো যদি অমান্য করা হয় তখন কিন্তু সেটা সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে। সরকার এগুলো ভঙ্গ করেছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসিন মন্টু বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বর জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচনকে কিভাবে অপ্রত্যাশিত প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত করা হয়েছে তার কিছু খ- চিত্র সোশ্যাল মিডিয়া ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পেরেছি। এ সভায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধি ও প্রার্থীদের বক্তব্য থেকে নির্বাচনে বিভিন্ন ন্যক্কারজনক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ একজোট হয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে চরম নৈরাজ্যকর ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশের জনগণকে অসহায় করে ফেলেছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যাদের নির্বাচতি বলে ঘোষণা করেছে তারা কেউ নির্বাচিত নন এবং যাদের গেজেট প্রকাশ করেছে তারা কেউ জনগণের প্রতিনিধি নন। আমরা ইতোপূর্বে এই নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা অনতিবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আমাদের হারানো গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবই। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলাম যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করতে পারি। আমি আশা করি ঐক্যফ্রন্ট যদি কার্যকর থাকে, তাহলে নির্বাচন ও অন্যান্য ব্যাপারে সরকার চাপে থাকবে। কামাল হোসেন দলের এমপিদের শপথের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানালেও মন্টু বলেন, তারা কেউ শপথ নেবেন না। নির্বাচনের বিষয়ে যেসব অভিযোগ করেছেন তার কোনো দলিল আছে কি-না বা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কি-না? জবাবে ড. কামাল বলেন, দলিলপত্র তো অবশ্যই আছে। আমরা যা বলছি তা তো দলিলপত্র দেখেই বলছি। গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আন্দোলনের দিকে যাবেন কি-না, বা গেলে কি ধরনের কর্মসূচী হবে? জবাবে কামাল বলেন, আন্দোলন তো আমরা করেই যাচ্ছি। জনমত গঠন করাও এক ধরনের আন্দোলন। আমরা আন্দোলন করে যাব। সেটা আরও তীব্র হতে পারে। জামায়াতকে নিয়ে পরবর্তী কর্মসূচী দেবেন কি-না জবাবে ঐক্যফ্রন্টের এ শীর্ষ নেতা বলেন, জামায়াত আমাদের ফ্রন্টে নেই। তারা ২০ দলীয় জোটে আছে। তিনি বলেন, আমি নেতাকর্মীদের বলেছিলাম সকাল থেকে কেন্দ্র পাহারা দেয়ার কথা। কিন্তু কাজ তো রাতেই শেষ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন? জবাবে তিনি বলেন, এক এক সরকার অভিনন্দন জানিয়েছে। তাদের সেই বক্তব্য যদি পড়েন তার মধ্যে অনেক কিন্তু থাকে।
×