ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায়বেলায় আক্ষেপ...

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

 বিদায়বেলায় আক্ষেপ...

রুমেল খান ॥ বৃহস্পতিবারের দিবাগত মধ্যরাত। হঠাৎই মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জারে একটি বার্তা পড়ে চমকে উঠতে হলো, ‘ভাই খুব খারাপ লাগছে! স্বপ্ন ছিল ২০ বছর ফুটবল খেলে অবসর নেব, কিন্তু তা আর হলো না। ১৯ বছরেই থেমে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় দলের হয়ে অধিনায়কত্ব করার স্বপ্নও স্বপ্নই থেকে গেল।’ শুক্রবারের সকাল। মোহামেডান ক্লাবে চলে গেলাম। দলের সব খেলোয়াড় নিজস্ব ক্লাব-বাসে উঠে বসে আছেন। বুয়েট মাঠে অনুশীলন আছে। এনামুল হক শরীফও দলের সঙ্গে যাবেন শেষবারের মতো, তবে অনুশীলন করবেন না। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এনামুল হক শরীফ। লড়াকু ফুটবল খেলে সমর্থকদের কাছে ‘টাইগার’ উপাধি লাভ করেন ২০০৭ সালে। সেই থেকে এখনও সবাই তাকে চেনে ‘টাইগার শরীফ’ নামেই। সেই টাইগার শরীফ ফুটবল জীবনের ইতি টানতে চেয়েছিলেন আরও দুই বছর পর। কিন্তু বিধাতার লীলাখেলায় তার বিদায়ের চিত্রনাট্যটা বদলে গেল। এই মৌসুমেই বিদায় নেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছেন তিনি। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে তিনি জানিয়েছেন, গত অক্টোবরে ফেডারেশন কাপের প্রস্তুতি হিসেবে মোহামেডানের হয়ে একটি প্রীতি ম্যাচে খেলেন আরামবাগের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে খেলতে গিয়ে বাজেভাবে হাঁটুতে চোট পান। ফলে খেলতে পারেননি ফেডারেশন কাপে। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী চার সপ্তাহের মধ্যেই তার মাঠে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ফেরা হয়নি। কারণ ব্যথাটা কমেনি। তারপরও অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা কাপে খেলার জন্য। কিন্তু ফিট না হওয়াতে সে আসরেও খেলা হয়নি। সামনেই প্রিমিয়ার লীগ শুরু। লীগে খেলতে পারার সম্ভাবনা যাচাই করতে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে হাঁটুর পরীক্ষা (এমআরআই) করান। সেখানেই ধরা পড়ে বিষয়টি। জানা যায় লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে তার। সার্জারি করাতে হবে। আর সার্জারি করলে প্রায় বছরখানেক ফুটবল খেলতে পারবেন না। এদিকে তার বয়সটাও হয়ে গেছে ৩৭। ফলে সবদিক বিবেচনা করেই চিরতরে বুটজোড়া তুলে রাখার কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন কুমিল্লার ছেলে শরীফ। শুক্রবারই কুমিল্লায় চলে যান শরীফ। যাবার আগে জানান, আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে (প্রথমপর্র্বে) খেলেই ফুটবলকে চিরতরে বিদায় জানাতে চান তিনি। ইতোমধ্যেই এটা মোহামেডান ক্লাবকে জানিয়েছেন। ‘আশাকরি তারা আমাকে মাঠ থেকে সম্মানের সঙ্গে অবসর নেয়ার সুযোগটা করে দেবে।’ শরীফের আশবাদ। লিগামেন্টের চোট নিয়ে কিভাবে আবাহনীর বিরুদ্ধে খেলবেন? কোচ কি মাঠে নামার অনুমতি দেবেন? ‘অবশ্যই দেবেন। দেখুন, আমি তো আবাহনীর বিরুদ্ধে পুরো সময় খেলব না। মাত্র ৫-১০ মিনিটের জন্য মাঠে নামব। এ ধরনের চোট নিয়ে অল্প সময়ের জন্য খেলাটা কোন সমস্যা নয়।’ শরীফের জবাব। বিপ্লব-কাঞ্চনের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়রা এখনও খেলে যাচ্ছেন, তাহলে কেন এই অবসর? ‘এটা আমি জানি। কিন্তু তারা কি সব ম্যাচেই খেলতে পারছে? খেলতে পারলেও কি প্রথম একাদশে খেলতে পারছে? আমি তো সাইডবেঞ্চে বসে থাকতে পারব না তাদের মতো। তাছাড়া এর আগে কখনই বদলি হিসেবে খেলিনি। এটা আমার ধাতে নেই। এখন আমার যে ফিটনেস, তাতে আরও পাঁচ বছর অনায়াসেই খেলতে পারতাম। মাঠ থেকে বিদায় নেয়ার সুযোগ সব ফুটবলারের জীবনে আসে না। আমিনুল হকের মতো দুর্দান্ত গোলরক্ষকও মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারেননি। কিন্তু যতদিনই খেলেছেন, বাঘের মতো খেলেছেন। আমিও তেমনটাই চাই। তাছাড়া মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী দলে খেলে অবসর নেয়ার সুযোগও আমাকে প্রভাবিত করেছে। এখনই বিদায় নেয়াটা পারফেক্ট হবে আমার জন্য। তাছাড়া একদিন তো খেলা ছাড়তেই হতো। ইনজুরির জন্য না হয় একটু আগেই ছাড়লাম।’ শরীফ আরও যোগ করেন, ‘আমাদের দেশে কোন ফুটবলারের বয়স ৩০ হলেই তাকে ‘বুড়ো’ বলা হয়। আর আমার বয়স তো ৩৭। যদিও আমি নিজে বয়সকে কোন ফ্যাক্টর মনে করি না। কিন্তু ক্লাবগুলো করে! তাই এই অবসরের সিদ্ধান্ত। হয়তো বলতে পারেন এক বছর পর ফিরে এসে ছোট কোন দলে খেলতে। কিন্তু শেখ জামাল, শেখ রাসেল, মোহামেডানের মতো বড় দলে খেলার পর এখন আমার পক্ষে অল্প পারিশ্রমিকে কোন ছোট-দুর্বল দলে খেলা সম্ভব নয়। এটা আমার মর্যাদার ব্যাপার। আমি বড় ক্লাবে খেলে মাথা উঁচু করেই বিদায় নিতে চাই।’ কুমিল্লায় শরীফের একটি ফুটবল একাডেমি আছে। নাম টাইগার একাডেমি। প্রায় ছয় মাস আগে এটি চালু করেন। এখানে ৪০ জন ছেলে ফুটবল প্রশিক্ষণ নেয়। তাদের ফ্রি কোচিং করান তিনি। ‘আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, আমার পরে কুমিল্লা থেকে যেন অনেক ফুটবলার জাতীয় দলে খেলতে পারে, পাইপলাইনে খেলোয়াড় সঙ্কট যেন না থাকে সে জন্যই এই একাডেমি করা।’ ফ্রি একাডেমি চালানোর তো অনেক খরচ? সেটা কিভাবে সামাল দেন? ‘যতদূর পারি নিজের টাকাতেই করি। না পারলে এলাকার কিছু শিল্পপতির কাছে বল কেনার জন্য অর্থ সাহায্য নিয়ে থাকি। তারা কখনই না করেন না। ফজলে রাব্বি, আসাদুজ্জামান বাবলু, ওসমান গনিসহ আরও অনেক তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারের ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন শরীফ। ভবিষ্যতে নিজের একাডেমি থেকে এরকম আরও অনেক ফুটবলার তৈরি করার স্বপ্ন দেখেন শরীফ, ‘অবসর নেয়ার পর ফুটবল একাডেমি থেকে খেলোয়াড় তৈরি করব যেন তারা জাতীয় দলে খেলতে পারে এবং কুমিল্লার নাম উজ্জ্বল করতে পারে। কখনই বাফুফেতে বা কোন ক্লাবের কোচ হব না। কারণ দেখেছি কোচদের কিভাবে হেনস্তা করা হয়।’ অবসরের সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া ছিল। তবে সেটা চূড়ান্ত করেন বৃহস্পতিবার রাতে। মোহামেডানের সব সতীর্থকে জানিয়েছেন। তারা সবাই অবসরের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অনুরোধ করেছেন। ‘বিশেষ করে জাহিদ হাসান এমিলি, তকলিস আহমেদরা তো মানতেই চায়নি।’ ফুটবলার ‘টাইগার’ শরীফের শেষ ম্যাচ ঢাকা আবাহনীর বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে দলকে জিতিয়েই বিদায় নেবেন তিনিÑ সাদা-কালো অনুরাগীদের সেটাই নিগূঢ় প্রত্যাশা।
×