ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেফতার পাঁচ শতাধিক, উদ্ধার ১ লাখ পিস ইয়াবা

মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বছরের প্রথম দিন থেকেই মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। মাদকবিরোধী যুদ্ধ যাতে শেষ না হয়, এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। মহাজোটের সংসদ সদস্যদেরও নিজ নিজ এলাকায় মাদকের বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত চারদিনের প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও গড়ে একজনের বেশি করে মাদক ব্যবসায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হচ্ছে। গ্রেফতার হয়েছে অন্তত পাঁচ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। উদ্ধার হয়েছে অন্তত এক লাখ ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক। মাদক দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছে সরকার। এই বাধা দূর করতে তাই মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে আরও জানা গেছে, তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর মাদকবিরোধী অভিযানের তীব্রতা আরও বাড়ানোর নির্দেশ এসেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতর থেকে। এবার ব্লকরেইড পদ্ধতিতে ঝটিকা অভিযান চালানো হবে। আর মাদক মামলায় এবং মাদকসহ গ্রেফতারকৃতরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার ও সিআইডির মুখপাত্র মোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, মাদকসহ গ্রেফতারকৃতরা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, এজন্য নানা কৌশল নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সিআইডি যৌথভাবে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। কর্মশালায় সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের সব বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সরকার মাদক নির্মূলে শতভাগ আন্তরিক। দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের তীব্রতা বাড়ছে। মাদক বিক্রেতা, মাদকের বড় বড় ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদের পৃথক পৃথক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকাভুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার যোগসূত্র রয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য কি ধরনের দুর্দিন যে আসছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। ইতোমধ্যেই সারাদেশে অভিযান শুরু হয়েছে। দিনকে দিন অভিযানের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এমন বার্তা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমানও। তিনি বলেন, একটি সময় আসবে, তখন হয় তো মাদক সেবীরা মাদকের অভাবে মাদক সেবনই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। ঢাকায় এত অভিযান চালানো হবে যে, মাদকই মিলবে না। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে মাদকের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে। তাতে জানানো হয়, সরকারী হিসেব মতে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যদিও প্রকৃতপক্ষে দেশে মাদকসেবনকারীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। দিনকে দিন মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাদকসেবীদের মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত। বাকি ৫০ লাখ অনিয়মিত মাদকসেবী। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তারা ফেনসিডিল ও ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদকে আসক্ত। ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব মাদক আসছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা না গেলে, মাদক দেশের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। দেশের উন্নয়ন পিছু হটতে বাধ্য। এমন তথ্যের পরপরই বিদায়ী বছরে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের এক সংসদ সদস্য মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে বক্তব্য দেন। সংসদে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রী সেদিন থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ ও র‌্যাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং বিদায়ী বছর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনেও মাদকের বিষয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। জঙ্গীবাদের মতো মাদককেও নির্মূল করার নির্দেশনা দেন। এরপর থেকেই মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতে জল ও স্থল সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে এবং দেশের ভেতরে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। পাশাপাশি ইয়াবা তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান উপকরণ সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়। কাঁশির ওষুধ তৈরিতে বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করতে কোস্টগার্ড, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত কৌশল ঠিক করে অভিযান চালানো হয়। বিদায়ী বছরের মের মাঝামাঝি সময় থেকে সারাদেশে চালানো সেই মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে স্থলভাগের নেতৃত্ব দেয় র‌্যাব ও পুলিশ। আর জলপথে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড। বিদায়ী বছরের ১৬ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে চালানো সেই অভিযানে ২০২ জন কুখ্যাত তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। আহত হয় অন্তত তিন শতাধিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শতাধিক সদস্য আহত হন। এক পুলিশ কর্মকর্তা মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে নিহত হন। গত ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর মাদকবিরোধী অভিযান আরও জোরালো হয়। মাদককে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আইন পর্যন্ত সংশোধন করা হয়। দুই শ’ গ্রাম ওজনের বেশি পরিমাণ ইয়াবা ও হেরোইনসহ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদন্ড করা হয়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মহাজোটের সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার পর সাক্ষাত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককেই মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলেছেন। নিজ এলাকায় যাতে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে না পারে এজন্য নিজ উদ্যোগে এমপিদের নজর রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন নির্দেশনার পর সারাদেশে ধারাবাহিকভাবে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। শুক্রবার কক্সবাজারে বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই চকরিয়া উপজেলার শাহারবিল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি খাল থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার হয়। পুলিশ বলছে, মাদক ব্যবসার জেরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তাদের মৃত্যু হতে পারে। গত ৩ জানুয়ারি কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবক নিহত হয়। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মাদকের মামলা ছিল। ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা ও পিস্তল জব্দ হয়েছে। একই দিন মেহেরপুরে দু’দল মাদক বিক্রেতার মধ্যে গোলাগুলিতে একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি শূটারগান ও ৩০ বোতল ফেনসিডিল জব্দ হয়েছে। শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায়ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। মেহেরপুর সদর থানার ওসি রবিউল ইসলাম জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোলাগুলিতে একজনের মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। শুক্রবার সাভারের বালিয়ারপুর এলাকা থেকে ৭০ কেজি গাঁজাসহ চার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-২। আর ঢাকায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪৯ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের মাদক জব্দ করা হয়েছে।
×