ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুলে রাতুলের প্রথম দিন

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

স্কুলে রাতুলের প্রথম দিন

আগামীকাল থেকে স্কুলে যাবে রাতুল। এ বছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে সে। রাতুলের বড় ভাই রাহুলও একই স্কুলে পড়ে। হুট করে বিছানা থেকে নিচে নেমে বুকশেলফের কাছে গিয়ে অন্ধকারেই কি যেন খুঁজতে শুরু করল রাতুল। শব্দ শুনে রাহুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ঘুম কণ্ঠেই জানতে চাইল রাহুল, কি করছ রাতুল? ভাইয়ার কাছে এসে উত্তর দিল রাতুল, বই খুঁজছি ভাইয়া। -কিসের বই? -আমি তো কাল থেকে নতুন স্কুলে যাব। কিন্তু আব্বু এখনও বই কিনে দেয়নি আমাকে। স্কুলের প্রথম দিনই কোন বই ছাড়া স্কুলে গেলে টিচাররা নিশ্চয় আমাকে ফাঁকিবাজ ভাববে। ফাঁকিবাজ বলেই কোন বইপত্র নিয়ে যাইনি, যেন পড়ালেখায় ফাঁকি দিতে পারে! ছোট ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে রাহুল। রাতুল সেদিকে তেমন খেয়াল করল না। সে আবারও নিজের মতো করেই বলতে শুরু করল, তাই ভাবলাম তোমার পুরনো বইগুলো সবই তো বুকশেলফে রেখে দিয়েছ। সেখান থেকে আমার ক্লাসের বইগুলো বের করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। কাল তোমার বইগুলো নিয়েই স্কুলে যাব। তাহলেই কেউ আর আমাকে ফাঁকিবাজ ভাবতে পারবে না। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে এবার আর হাসি কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না রাহুল। ভাইয়ার হাসি দেখে অবাক হলো রাতুল। হাসার মতো কি বলেছে সে! কিছুটা সময় পর হাসি থামাল রাহুল। এবার সে রাতুলকে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল, শোন রাতুল, আগামীকাল তো তোমার স্কুলের প্রথম দিন। আর প্রতিবছরের প্রথমদিন বাংলাদেশ সরকার দেশের সবগুলো স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বই পাঠায়। বই কিনতে হয় না। এই যে বছরের প্রথম দিনেই সরকার যে সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করে এটাকে বলা হয় বই উৎসব। প্রতিটা স্কুলে সবার জন্য বই পৌঁছে গেছে এরইমধ্যে। আগামীকাল যখন তুমি স্কুলে যাবে তখন দেখবে প্রথমে এ্যাসেম্বলি লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে শপথ বাক্য পাঠ আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর, ক্লাস টিচাররা সবাইকে যার যার ক্লাসরুমে নিয়ে যাবেন। ক্লাসরুমে গিয়ে টিচার সবার হাতে এক এক করে বই তুলে দেবেন। এরপর সবাইকে বই দেয়া শেষ হলে ছুটি দিয়ে দেয়া হবে। পরেরদিন থেকে ক্লাস শুরু হবে। বুঝেছ?- তার মানে তো আমিও কালকে স্কুল থেকেই নতুন বই পাব, তাই না ভাইয়া? -হ্যাঁ, এখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়। ভাইয়ার কথা মতো বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল রাতুল। এখন আর তার মনে কোন চিন্তা নেই। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়ল সে। পরদিন সকালে আম্মু এসে ঘুম ভাঙালেন রাতুলের। ভাইয়া অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। রাতুলও হাতমুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসল। নাস্তা শেষ করে ঘরে চলে গেল দুই ভাই। আম্মুও ঘরে ঢুকলেন রাতুলকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে দেয়ার জন্য ওদের পেছনে পেছনে। এতদিন যাবত এই স্কুল ড্রেসগুলোই পরার জন্য অপেক্ষা করছিল রাতুল। প্রতিদিন একবার করে আলমারি থেকে স্কুল ড্রেস বের করে একবার করে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দেখত সে, যেন দাগ না লেগে যায় সাদা শার্টে। আম্মু এসে আলমারি থেকে স্কুল ড্রেস বের করে পরিয়ে দিলেন রাতুলকে। রাহুলও তার স্কুল ড্রেস পরে তৈরি হয়ে গেছে। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে রাতুল। কি হয়েছে, হাসছ কেন রাতুল? প্রশ্ন করল রাহুল। -আমার তো প্রথম স্কুল, তাই নতুন ড্রেস পরে স্কুলে যাচ্ছি। তুমি তো আগে থেকেই স্কুলে পড়। গত বছরের স্কুল ড্রেসগুলো এখনও গায়ে লাগে। তাই পুরনো স্কুল ড্রেস পরেই তোমাকে স্কুলে যেতে হচ্ছে। রাতুলের কথাগুলো শুনে মজা পেল রাহুল। প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার আনন্দটা এমনই রূপকথার মতো সুন্দর রাহুল খুব ভাল করেই জানে। ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বললেন আম্মু, এবার বের হতে হবে আমাদের। না হলে দেরি হয়ে যাবে। আম্মুর সঙ্গে দুই ভাই বেরিয়ে পড়ল স্কুলে যাওয়ার জন্য। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতেই রাতুল দেখল গত রাতে ভাইয়া যেমন বলেছিল, ঠিক একইভাবে সবাই যার যার ক্লাস অনুযায়ী এ্যাসেম্বলি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। রাতুলকে ক্লাস ওয়ানের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভাইয়া নিজের ক্লাসের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। জাতীয় সঙ্গীত শেষে সবাই যার যার ক্লাস টিচারের সঙ্গে ক্লাসরুমে চলে গেল। এক এক করে সব ক্লাসেই বই বিতরণ কাজ শেষ। ছুটির ঘণ্টা বাজলে বইগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে ধীর পায়ে আম্মুর কাছে এসে দাঁড়াল রাতুল। গেটের কাছে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল আম্মু আর ভাইয়া। আম্মুর কাছে আসতেই বলে উঠলেন, বইগুলো ব্যাগে ঢোকাও বাবা। এভাবে ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে না? -না আম্মু, বইগুলো ক্লাসে খুলে দেখেছি আমি। কত সব রঙিন রঙিন ছবি আর অনেক গল্প কবিতাও আছে বইয়ে। মনে হচ্ছিল বইয়ের ছবির গাছ, ফুল, পাখি, বাঘ, সিংহগুলো বেরিয়ে আসবে আমার কাছে। এরপর আমি ওদের সঙ্গে খেলব। আম্মু আর রাহুল আবারও রাতুলের ছেলে মানুষীতে হেসে ফেলল। পাশ দিয়ে একটা যাত্রীবিহীন রিক্সা যেতে দেখে ডাক দিয়ে থামাল রাহুল। এরপর সেই রিক্সায় করে বাসায় ফিরল তারা। বাসায় ঢুকেই রাতুল একদম ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কি যেন খুঁজছে ও! আম্মু জিজ্ঞাসা করলেন, কি খুঁজছ রাতুল? ব্যস্ত কণ্ঠে জবাব দিল রাতুল, গত বছরের ক্যালেন্ডারগুলো কোথায় আম্মু? -ওগুলো তো শেলফের ওপর রেখে দিয়েছি। যেন তোমার আব্বু বাসায় ফিরে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো দিয়ে বইয়ে মলাট বেঁধে দিয়ে পারেন। দেখ না, তোমার ভাইয়ার বইয়ে প্রতিবছর আব্বু কি সুন্দর মলাট বেঁধে দেন। তখন আর বইয়ের কভার ছিড়বে না বা নষ্টও হবে না। -জানি তো আমি আম্মু। কিন্তু ক্যালেন্ডারগুলো আমাকে এনে দাও এখনই। ছেলের জোরের কাছে হার মেনে ক্যালেন্ডারগুলো নিয়ে আসলেন আম্মু। ক্যালেন্ডারগুলো হাতে নিয়েই পাতা উল্টাতে শুরু করেছে রাতুল। আর নিজের ইচ্ছামতো বেছে বেছে ক্যালেন্ডারের পাতায় নিজের নাম লিখছে সে। আম্মু আর রাহুল দুজনেই তাকিয়ে তাকিয়ে রাতুলের কান্ড দেখছে। নাম লেখা শেষ হলে মুখ তুলল রাতুল। আম্মু আর ভাইয়া দুজনেই রাতুলের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কি জানতে চায় তারা সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না রাতুলের। বলল, সুন্দর সুন্দর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলোয় নিজের নাম লিখে রাখলাম। যেন আব্বু আমাকে এই পাতাগুলো দিয়েই বইয়ে মলাট বেঁধে দেন। আমার নাম লেখা পাতা দিয়ে তো আর ভাইয়ার বইয়ে মলাট বাঁধাতে পারবেন না। আর আমার বইগুলোই তখন বেশি সুন্দর দেখাবে। এরপর নিজের দুষ্টু বুদ্ধি আড়াল করতে হেসে দিল রাতুল। আর রাতুলের এমন দুষ্টু মিষ্টি কান্ড কারখানা দেখে হাসতে শুরু করলেন আম্মু আর ভাইয়াও। তৃতীয় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×