ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক জহুরুল আলম

গণরায়কে সম্মান করুন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

 গণরায়কে সম্মান করুন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গণমানুষের যে বিপুল আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে আওয়ামী লীগের অবিস্মরণীয় বিজয়ে, তা প্রতিটি বাঙালীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ১৯৫৪ সালের ও ১৯৭০ সালের গণরায়কে। যখন এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যালটের মাধ্যমে রুখে দিয়েছিল শত্রুর সকল ষড়যন্ত্র। রচনা করেছিল প্রতিরোধের সুকঠিন বর্ম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণরায় বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল স্বাধীনতা ঘোষণা করার ম্যান্ডেট যে ঘোষণা এসেছে তাঁর ৭ মার্চের বক্তব্যে ও ২৬ তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই ঊষালগ্নে যখন নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া গণরায়টি ছিল বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি, তখন কিছু অতিবাম-অতিডান ঐক্য ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ ধরনের মুখরোচক স্লোগানের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছিল। এই শক্তিই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে দেশকে পকিস্তান বানানোর পরিকল্পনার সময়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কিন্তু কখনও হত্যাকারীদের সে সব উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে কখনও উচ্চবাচ্য করেননি, সম্ভবত তাদের পূর্বতন ভূমিকার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধের কারণে। এমন কি তাঁদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন সংস্থা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এখানেই তাঁর সঙ্গে অন্যান্য এ দেশীয় রাজনীতিবিদদের ভিন্নতা। তাঁর অন্তঃকরণ তাঁর পিতার মতোই মহান, বলাই বাহুল্য। এই নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এখানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম, যারা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তারা স্বপ্ন দেখছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের যে দেশ হারিয়ে গিয়েছিল কোন এক অচলায়তনে। বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ২৫ জন জামায়াতীর একজনকেও জনগণ গ্রহণ করেনি। এটা ছিল স্বাধীনতা ও উন্নয়নের পক্ষের শক্তির প্রতি গণমানুষের পূর্ণ আস্থার প্রতিফলন। নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য ও বিভিন্ন জরিপ ও মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে পাওয়া ধারণাগুলো ছিল সম্পূর্ণরূপে পরস্পরবিরোধী। ড. কামাল গং এমন একটি হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন যে- নির্বাচনের দিন দেশের সকল মানুষ দলে দলে গিয়ে বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার মুক্তির জন্য ভোটের বাক্স ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ভরে দিয়ে আসবে। সে ধরনের চিন্তা করার পিছনে কোন বালখিল্য যুক্তি ছিল তা তারাই বলতে পারবেন। সম্ভবত এই লোকগুলো ভুলে গিয়েছিল যে- গত দশ বছরে দেশের মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া মানুষ তার জীবন-জীবিকার প্রশ্নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা উন্নয়ন মডেল ও উন্নয়নের ধারার মাঝেই তাদের আস্থার স্থানটি খুঁজে পেয়েছে। যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের হতাশ সুশীল বাবুরা বাংলার স্বচ্ছ জল ঘোলা করার পাঁয়তারার শুরু করেছেন তা হলো আসলেই কি বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট এমন বিশাল ব্যবধানে হেরেছে? এ যে বসিয়ে দেয়া নয়, একেবারে রাস্তায় থালা হাতে নামিয়ে দেয়ার মতো ব্যাপার! ২৮৮ আসনের বিপরীতে মাত্র ৭টি আসন! এমনকি যে জাতীয় পার্টিকে ওরা চিরকাল অস্পৃশ্য হিসেবেও মর্যাদা দিতে কার্পণ্য বোধ করেছে সেই জাতীয় পার্টির অধীনস্ত বিরোধী দল হিসেবেই এবার তাদের অগস্ত্যযাত্রার শুরু হতে যাচ্ছে। আর সে যাত্রায় অংশগ্রহণ না করলে তাদের সামনে রয়ে যাবে গহীন অমানিশা। আমাদের ইতিহাস বলে, জাতির যে কোন ক্রান্তিলগ্নেই এ দেশের বীর জনতা দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়, যা মোট আসনের শতকরা ৯৪ ভাগ ছিল। এককভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি বা ৬০ ভাগ। আর সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি সংরক্ষিত আসন আমলে নিলে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল শতকরা ৭৬ ভাগ আসন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অওয়ামী লীগ পাকিস্তান ন্যাশনাল এ্যসেমব্লীতে ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্বপাকিস্তান থেকে ১৭০টি আসনে প্রার্থী দেয় এবং ১৬০টি আসনে জয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি অসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে (৯৬%) জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৩০ ডিসেম্বরের (২০১৮) সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৯৮টি আসনের মধ্যে মোট ২৮৮টি আসনে বা শতকরা প্রায় ৯৭ ভাগ আসন নিয়ে জয়ী হয়। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে যে দুটি কথা প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে- এই যে এ জাতির বিশ্বাস অর্জনকারী শক্তিকে জাতি সর্বদাই সবচেয়ে বেশি প্রতিদান দিয়েছে, প্রকারান্তরে বিশ্বাসঘাতকদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। পাকিস্তান আমলে এ দেশের জনগণ এত বড় বিজয় অর্জন করেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কখনোই ক্ষমতায় টিকতে পারেনি বা আসতে পারেনি। আর এ দেশেও নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন দান করে যেতে হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতিকে ও আর হাজারো দেশপ্রেমিককে। ইতিহাসে বিপ্লব, গণজাগরণ, গণআন্দোলন, এ জাতীয় বিষয়গুলো এসেছে মানুষের অন্যায়-অবিচারের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিরোধের আকাক্সক্ষা থেকে। আর এ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে আলোকবর্তিকা হয়ে আসা শক্তিকে জনতা সর্বদাই দিয়েছে অভূতপূর্ব সমর্থন। জনতার চিন্তাধারা সরল ও মহান, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিতে শেষাবধি ভুল করে না। তাই মানুষের অনেক আচরণ অবুঝ বিজ্ঞজনের কাছে অতি অদ্ভুত ধাঁধাসদৃশ মনে হলেও আসলে তা তাদের সরল মনের প্রকাশিত অভিব্যক্তি যা কুটিল মহাজনের নিকট অতীব জটিল। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের জনগণের এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত অনেক কুশীলবের বোধশক্তির বাইরে। অথচ সাধারণ্যে তা এক অতীব সরল সমীকরণ। বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের বা ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপির এই লেজেগোবরে অবস্থা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে। ভোটের তরণীতে এক পা রেখে এরা অন্য পা রেখেছিল ষড়যন্ত্রের ফাঁদে। নির্বাচনকে হেয় ও প্রশ্নবিদ্ধ করার লন্ডনী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরা সকল প্রকার প্রচারণা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে। সেই সঙ্গে তফসিল ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই নির্বাচন কমিশনে ও বিদেশীদের কাছে নালিশের বস্তা নিয়ে হাজির হতে থাকে। লন্ডনে বসে তারেক রহমান খুলে বসে নির্বাচনবাণিজ্য। একই আসনে অসংখ্য নমিনেশন দিয়ে পরে আসনগুলো নিলামে তোলা হয়। উল্লেখ্য, বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট মোট ৩০০ আসনে নমিনেশন দেয় প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রর্থীকে। তারপর যার কাছ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য পাওয়া যায় তার কাছেই প্রার্থিতা বিক্রয় করা হয়। এভাবে প্রার্থী নির্বাচন করার ফলে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক শক্তিশালী প্রার্থী বাদ পড়ে যায় ও মাঠপর্যায়ে অসন্তোষের ফলে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি কার্যত দ্বিধাবিভক্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নির্বাচনকালীন পুরো সময়ে বিএনপির প্রার্থীরা প্রচার প্রচারণা থেকে বিরত থাকে এই বলে যে তাদেরকে বাধা দেয়া হচ্ছে। এমন ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল, বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে নমিনেশন বাণিজ্য থেকে তারেক রহমানের তহবিলে ১০০ কোটি টাকা জমা হয়। মোদ্দাকথা, মহাজোটের ব্যাপক প্রচারণার বিপরীতে ঐক্যফ্রন্টের নিষ্ক্রিয়তা ও ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা মানুষকে এই জোট বা দল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের ভোটারদের জন্য ঐক্যজোট কোন আশার বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়, যেখানে শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য বিশাল উন্নয়নের ও কর্মসংস্থানের সোনালী ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হন। মানুষকে স্বপ্ন দেখান আত্মমর্যাদাশীল জাতি হয়ে বিকশিত হওয়ার। আর এখন তো অনেক বিএনপি নেতাই দলের বালখিল্য আচরণের জন্য তারেক রহমানকে সরাসরি দায়ী করে বিবৃতি দিচ্ছে। নিউইয়র্কে অবস্থানরত সাদেক হোসেন খোকা মন্তব্য করেন : ‘বিএনপির এই পরিণতির জন্য একমাত্র দায়ী তারেক জিয়া। তার ভুল সিদ্ধান্ত এবং অপরিপক্বতার জন্যই বিএনপি আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। লন্ডনে বসে ঢাকার রাজনীতি হয় না। এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে তারেক এক নাবালক শিশু।’ আসলে তারেক অতি চালাকির রাজনীতি না করে দলকে নির্বাচনী রাজনীতি করার সুযোগ দিলে ঐক্যজোটের থলিতে হয়তো আরও দু-চারটি আসন পাওয়া যেত। আরেকটি বিষয় স্বতঃসিদ্ধ যে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত-বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠী এখনও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। তারেক ও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নির্বাচনে এদের সক্রিয় কদাচার আশা করেছিল। কিন্তু তা ঘটেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে লন্ডনপন্থী উড়নচ-ীসুলভ কোন বালখিল্যতায় মজে না থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা। আর সে জন্য পাঁচটি আসন নিয়ে হলেও শপথ গ্রহণ করে জাতীয় সংসদে গিয়ে নিজেদের ইতিবাচক রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে মানুষের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করা। জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা করে তা মেনে নেয়া। মনে রাখতে হবে, জিয়া ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য সব কিছুই করেছে। তারপরও বঙ্গবন্ধুর ও গণমানুষের এই দল শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, মেধা, সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা, কৌশল ও জনগণের প্রতি অপার মমত্ববোধের কারণে আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো দেশের সেবা করতে যাচ্ছেন। লেখক : শিক্ষাবিদ
×