ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মামুনুর রশীদ

তাঁর ‘বিকল্প’ এ জনপদ কবে জন্ম দেবে আবার

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

 তাঁর ‘বিকল্প’ এ জনপদ কবে জন্ম দেবে আবার

ভোরবেলা কোন এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। সামাজিক মাধ্যমে চোখ বুলাতেই ছোট ভাই পাভেল রহমানের কিছু অভিব্যক্তি সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে। সেই অভিব্যক্তি দিয়েই স্মৃতিচারণটা শুরু করছি। ‘আমরা কথায় কথায় আমাদের নেতাদের নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে হুটহাট নির্দিষ্ট দল/সিস্টেমকে দায়ী করে বসি না? এইটা আসলে অহেতুক! আমার মনে হয় কি, নেতা তৈরি হওয়া না হওয়া কিংবা ভাল বা খারাপ হওয়ার দায় মূলত একটা জনপদের। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন কিংবা নজরুল ইসলামরা কিন্তু একদিনে অমনি অমনি আসেনি, টুঙ্গিপাড়া থেকে একটু একটু করে কাঁচামাটির বয়স পেরিয়ে নিজেকে গড়ার সুযোগ পেয়েছেন খোকা, রাজপথের পিচগলা উত্তাপ সে নরম মাটিকে রং আর কাঠিন্য এনে দিয়েছে। বঙ্গতাজ দিনের পর দিন কাপাসিয়া-জয়দেবপুর-নারায়ণগঞ্জের হাজার মাইল কাঁচারাস্তা পাড়ি দিয়েছেন তার সাধের বাইসাইকেলে করে, গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক, ক্ষেতের মাঝখানে গোপন মিটিং, বিপ্লবের স্বপ্ন আর মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধ তাঁকে বড় করেছে... সৈয়দ নজরুলরা মানুষকে ভালবাসতে জানতেন, তাঁরা এক ডাকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে জড়ো করে ফেলতে পারতেন যারা সত্যি সত্যি বৈঠা-কাস্তে-লাঙল-হাতের ঝুড়ি ফেলে শুধু ভালবেসে নেতার কথা শুনতে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত থেকে কোমরে মুড়ি গুড়ের টুপলা গুঁজে বের হয়ে যেত। সর্বজন সমৃদ্ধ রাজপথ আর খোলা আকাশের গনগনে সূর্যের উত্তাপে পুড়ে পরিণত হওয়া নেতা খুবই কম। বলতে গেলে তেমন পাইনি। এই না পাওয়ার ভিড়ে ব্যতিক্রম একজন সৈয়দ আশরাফ। জাতীয় নেতার ছেলে হিসেবে পাওয়া রাজনৈতিক স্টারডম ছুড়ে, কিউট নেতা না হয়ে তিনি বরং অনেকখানি মাটির, অনেকখানি মানুষের ঘামের গন্ধের, নষ্ট ফসলের সামনে বসা কৃষকের কান্নার জলের- মোদ্দা কথা তিনি শুধু কিশোরগঞ্জের না হয়ে, ছিলেন আমাদের সবার, এই জাতির। পরিপূর্ণ, বর্ষীয়ান, মানুষের অকৃত্তিম ভালবাসার এই মানুষটা আর নেই ভাবতে পারছি না, মৃত্যুর আগের শেষ ইলেকশনেও তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সৎ এই মানুষটি শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রাণের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাঁকে অবশ্যই মনে রাখবে তাঁর নির্লোভী, ডেডিকেটেড, রাজনৈতিক দূরদর্শী, বিশ্বাসী আর সাংগঠনিক যোগ্যতার গুণাবলীর জন্য। আর বাংলার মানুষ তাঁকে ভালবাসবে তাঁর সৌম্যশান্ত অবয়ব, নেতৃত্বগুণ আর মানুষকে ভালবাসবার প্রচন্ড আকাক্সক্ষার জন্য। একজন সৈয়দ আশরাফ বছর বছর আসে না, গত ত্রিশ বছরে আসেনি, আবার কবে আসবে জানি না। নষ্ট সময়ে হাল ধরার জন্য তাঁর মতো নেতা পেতে আমাদের আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হয় কে জানে তা! ওপারে ভাল থাকবেন সৈয়দ আশরাফ, আপনার বিকল্প এ জনপদ কবে জন্ম দেবে আবার?’ নির্লোভ আর নিরহঙ্কারী একজন সাদা মনের মানুষ জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আশরাফ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। অসংখ্য শহীদের রক্ত মিশে আছে এই নামটির সঙ্গে। এই নামের প্রতিছবি অবারিত হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন সৈয়দ আশরাফ। সৈয়দ আশরাফ শুধু একটি নাম নয়, এই নামটি মিশে আছে আওয়ামী লীগের স্মৃতির পাতায়। পিতার রক্তের গর্বিত সিপাহশালা ছিলেন তিনি। বাঙালীর জন্ম-জন্মান্তরের মুজিবাদর্শের প্রেমের ঠিকানা ছিলেন তিনি ও তাঁর বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বার বার দলের দুঃসময়ের ঝান্ডা বহনকারী হিসেবে বেশ সুপরিচিত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১ জানুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সৈয়দ আশরাফ ছিলেন একাত্তরের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির পরিমন্ডলে ছিল বেশ সুপ্রসন্ন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রক্তপিপাসুদের রক্তের পিপাসায় হারাতে হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকেও। ৩ নবেম্বর পিতার মৃত্যুর পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। সৈয়দ আশরাফ ফেডারেশন অব বাংলাদেশী ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ) এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আশরাফুল দেশে ফিরে আসেন। বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুইবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সপ্তম ও অষ্টম, কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এর পূর্বে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়াও তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। যখন আবদুল জলিল গ্রেফতার হন, তখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের (পরে ইসলাম) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই দম্পতির মেয়ে রীমা, যিনি লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যতদিন বাংলাদেশের বুকে থাকবে ততদিন সৈয়দ আশরাফের নাম স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত থাকবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আরেক অবারিত আলো দেয়া মানুষ, যেখানে চন্দ্র, সূর্যের আলো না থাকলেও অন্ধকার আসেনি সেই মানুষটি আর নেই কথাটির মধ্য দিয়ে দলটির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। নির্লোভ এই মানুষটি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক আজীবন। আমরা মহান মানুষটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফ বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেয়ার আগে বলেছিলেন যতদিন সৈয়দ আশরাফ রয়েছে ততদিন ওই আসনে আমি অন্য কাউকে মনোনয়ন দেব না। তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তিনি শপথ নিতে পারেননি। একজন সৈয়দ আশরাফ এখন আমাদের অনুভূতি, আর অনুপ্রেরণার নাম হয়ে থাকবে। ভাল থাকবেন নেতা! লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
×