ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি ধসের প্রত্যক্ষদর্শীর প্রার্থনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

একটি ধসের প্রত্যক্ষদর্শীর প্রার্থনা

আগার গাছ আর গোড়ার মাটি কেটে নিলে পরের বর্ষায় পাহাড়ের ধস ঠেকানো কঠিন। ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির যে ধস, এমন ধস স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। না বিএনপি, না আওয়ামী লীগ। ধস যে তাদের প্রত্যাশিত ছিল তা অবশ্য টেলিফোন কল লিকের সুবাদে সবার জানা। নির্বাচনের দু’দিন আগেই দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্যের সঙ্গে দলের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতার যে ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে তাতেই স্পষ্ট যে, তারা ২০-২২টির বেশি আসনের আশা করছিলেন না। নির্বাচনের আগে আগে আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থার জরিপেও বলা হয়েছিল তাদের মোট আসন ৫০ ছাড়াবে না, আর আওয়ামী লীগের ঘরে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতেছে ঠিকই, তবে বিএনপির গোলায় উঠেছে মাত্র ৭টি আসন। তাও দুটি আবার ভাড়াটে প্রার্থীদের বদান্যতায়। পরাজিত হয়েছেন বিএনপির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির প্রত্যেক নেতা। হারার কারণ সঙ্গত কারণেই খুঁজে বের করতে ব্যস্ত বিএনপি নেতৃত্ব। কিন্তু যা প্রত্যাশিত তাই হচ্ছে। কারণ খোঁজা হচ্ছে পরের ঘরে। নিজের আয়নায় নিজের মুখ দেখায় যে অনীহা বিএনপির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আবারও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখছি আমরা। জুনিয়র সহকর্মী ডাঃ শরিফুল মতিন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে সম্প্রতি লিখেছেন, নির্বাচনে অন্যরকম কিছু হলে বিএনপি এর চেয়ে ঢেড় বেশি সিট পেত। ডাঃ মতিনের স্ট্যাটাসটির সঙ্গে একমত হতে দেখেছি অনেককেই। নির্বাচন নিয়ন্ত্রিত হলে বিএনপির আরও অনেক বড় নেতার নামই সম্ভবত সদ্য প্রকাশিত গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হতো। বাস্তবতা হচ্ছে, কোটি-কোটি এন্ডরয়েড মোবাইল আর দুই ডজনের বেশি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আজকের এই বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আর যাই করা যাক না কেন, দেশব্যাপী ২৯৯টি আসনে দু’লাখেরও বেশি পোলিং বুথে ছয়-নয় করা হবে আর তার একটি ছবি বা ভিডিও এখনও প্রকাশ পাবে না এটি একেবারেই অসম্ভব। রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় বলেন, রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। কথা সত্যি। সংসদে না হোক বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের যে লম্বা তালিকা সেখানে তো এখনও বর্তমান মুসলিম লীগ। বিএনপি যদি মুসলিম লীগের চেয়ে ভাল কোন ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করে, তবে তাদের উচিত হবে বর্তমানকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা আর অন্যের ঘরে ফুটো না খুঁজে আয়নায় নিজেকে দেখা। এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মূল নির্ধারক ছিল এক কোটিরও বেশি নতুন ভোটার। এই বিশাল ভোট ব্যাংকটিকে আকর্ষণ করার কোন চেষ্টাই বিএনপির নির্বাচনী তৎপরতায় দেখা যায়নি। নতুনরা পুরনো নেতৃত্ব বেছে নিয়েছেন মূলত দুটি কারণে। একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আর অন্যটি ডিজিটাল বাংলাদেশের হাতছানি। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার আর নমিনেশনে এ দুটি বিষয় ছিল একবারেই অনুপস্থিত। এবার যে শুধু ২২ জন জামায়াতী ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছে তাই নয়, বরং এমন ৭ জন তাদের প্রার্থী হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার চলমান কিংবা তদন্তাধীন। একজন তো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিদেশে ফেরারীও। নমিনেশনের তালিকায় আরও ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলীম আর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীর ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়রাও। আর নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের ভাষায় ‘প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের কথা বলে বিএনপি আরও একবার পরিষ্কার করে দিয়েছে, ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বর্তমান বিচার প্রক্রিয়াকে উল্টে দেবে। ইশতেহারে বলা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের ভাষায় ‘প্রকৃত জাতীয় বীরদের’ নাম। ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে বিএনপি জমানায় উল্টো ধারায় প্রবাহিত হবে এসব বিষয় জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৩০ তারিখের অনেক আগেই। পাশাপাশি আউটসোর্সিং-এ যে দেশ পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানে, সে দেশের তরুণ ভোটাররা যদি কোন দলের বা জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে সব খুঁজে পেলেও, খুঁজে না পায় ডিজিটালাইজেশনের দিক নির্দেশনা, বরং উল্টো দেখতে পায় ক্ষমতার পটপরিবর্তনে উঠে যাবে সরকারী চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা, তখন সেই তরুণরা যে অমন ইশতেহারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে সেটাই তো প্রত্যাশিত। বিএনপির মনোনয়নের তালিকায় এবার শুধু ’৭১-এর খুনীদেরই মূল্যায়ন করা হয়নি, মূল্যায়ন করা হয়েছে এদেশের প্রতিটি কালো অধ্যায়ের কুশীলবদের। মনোনয়ন পেয়েছে ’৭৫-এর খুনীর স্ত্রী, ২১-আগস্টের গ্রেনেড হামলার খলনায়কের পরিবারের সদস্য আর সেই সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষকরাও। বাংলাদেশে মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ যে কয়টি কারণে অতি প্রিয় তার অন্যতম আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা আর একাগ্রতা। গত ১০টি বছরে যা আমরা চিন্তাও করিনি, ভাবিনি স্বপ্নেও, তাই হতে দেখেছি। বিচার হয়েছে বঙ্গবন্ধুসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের খুনীদের আর ’৭১-এর ঘাতকদের। বিচার পেয়েছেন জাতীয় চার নেতা আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও। বিচারহীনতার পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বিএনপির এই যাত্রায় তাই শরিক হতে চাননি কেউই। বাংলাদেশের সামনে আজকের বড় চ্যালেঞ্জ একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে উপস্থিত থাকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণায় এমনকি আওয়ামী লীগারদেরও উচ্ছ্বসিত করতালিতে মুখর হতে দেখেছি। বুঝেছি জাতির প্রত্যাশাও তাই-ই। এর বিপরীতে বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির দায়ে দ-িত নেতার সক্রিয় অংশগ্রহণ, লাগামহীন মনোনয়ন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে গুলশানে প্রকাশ্য দলীয় বিদ্রোহ আর ২ তারিখে জেলের তালা খুলে দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত দলীয় নেত্রীকে কারামুক্ত করার ঘোষণা কিংবা বা তারও আগে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নৈতিকস্খলনজনিত অপরাধে অপরাধীকে দলীয় নেতৃত্বে পাকাপাকি করার বন্দোবস্ত কখনোই জনপ্রিয় হয়নি। বিএনপির মাথায় যে পচন ধরেছে তার জন্য ভুগেছে পুরো দল আর দলের তৃণমূল। নেতৃত্ব শূন্যতায় কাতর বিএনপিকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নির্ভর করতে হয়েছে ভাড়াটে নেতৃত্বের ওপর। তাও এমন নেতৃত্ব যাদের নেতৃত্বের ভারে ভারাক্রান্ত শুধুই টিভি টক শো, মাঠের রাজনীতিতে তারা প্রত্যেকেই নো’শো। এদের মধ্যে হাতেগোনা দু’-একজন বাদ দিয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়ার কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়লাভের অভিজ্ঞতাও বাদ-বাকিদের শূন্য। কোথায় তারা বিএনপিকে পার করবেন, তারা বরং বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছিলেন জাতীয় সংসদে লোভনীয় আসনগুলোয় নিজেদের আসনগুলো নিশ্চিত করার তাগিদে। লাঠিতে ভর দেয়া বৃদ্ধ নেতৃত্ব কখনোই জনমানসে শেখ হাসিনার বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। তার উপরে ছিল লন্ডন বনাম ঢাকা, নয়াপল্টন বনাম গুলশান, জামায়াত তোষণকারী বনাম সো’কলড মডারেটর, বনেদি বনাম সুযোগসন্ধানী আর সংস্কারপন্থী বনাম বিশ্বস্ত ইত্যাদি নানা ধারায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন দলীয় নেতৃত্ব। নির্বাচনে জিতলে যারা তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর নামটি পর্যন্ত জানাতে পারেনি, তাদের পিছনে আপামর জনগণ তো দূরে থাক দাঁড়ায়নি এমনকি দলীয় তৃণমূলও। গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি আর তার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির মাঠ ফাঁকা করে দেয়া এরই পরিচয়বহ। সিলেট শহরে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে নৌকার বিশাল মিছিলের পিছনে হাত পাখার মুষ্টিমেয় সমর্থকদের সরব উপস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। অথচ সেদিন দেশের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী এলাকাটিতে ধানের শীষের একটি মিছিলও ছিল না। রাজনীতিতে অর্বাচীন হাত পাখার সমর্থকদেরও যতটা আস্থা তাদের নবিস নেতৃত্বে, তার কিয়দংশের দেখাও এবারের নির্বাচনে মেলেনি ধানের শীষের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে। এবারের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্ব আগারটাও খেয়েছেন আর কুড়িয়েছেন তলারটাও। পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্যে গাড়িতে আগুন দিয়ে লাঠি হাতে বীরদর্পে দলের নবিস নেতৃত্বের রাজপথে বাহাদুরি মানুষকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১৪-১৫’র আগুন সন্ত্রাসের দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। আর বিএনপির কফিনে শেষ পেরেকগুলো ঠুঁকে দিয়েছে লন্ডন থেকে সম্প্রচারিত কয়েকটি ভিডিও বার্তা, যেখানে গত ১০ বছরে সরকারী চাকরিতে যোগদানকারী সব কর্মকর্তা আর পুলিশ অফিসারের চাকরি কেড়ে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে আর নির্বাচনের আগের দিন বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের আহ্বান জানানো হয়েছে নির্বাচনকে ‘প্রতিহত, প্রতিরোধ আর বর্জন’ করার। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির এই ধস তাই মোটেও অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা ছিল না। পাহাড়ের আগার গাছ আর তলার মাটি কেটে নিলে আপাতদৃষ্টিতে যে বিশাল পাহাড়, পরের বর্ষায় তা ধসে পরে বিনা ঘোষণায়। ৩০ ডিসেম্বর আমরা তেমনই একটি ধস প্রত্যক্ষ করেছি মাত্র। এখন সাধু বুঝলে হয়! সংসদীয় রাজনীতিতে একটি সুস্থধারার বিরোধী দলের যে অভাব বাঙালীর বোধে, সেই অভাব অন্যথায় হয়ত আর কোনদিনও কাটিয়ে ওঠা হয়ে উঠবে না। এটি না ভাল বাংলাদেশের জন্য, না আওয়ামী লীগের জন্য। একাদশ সংসদের সংসদরা যখন শপথ নিচ্ছেন তখন কায়মনোবাক্যে আমার প্রার্থনা একটাই- ‘ হে প্রভু, এদের সুমতি দাও’! লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×