ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপন নাথ

শব্দ ঘরের শব্দের কারিগর

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

শব্দ ঘরের শব্দের কারিগর

মোহিত কামাল সাহিত্যচর্চায় প্রতিষ্ঠিত এক নাম। এ ছাড়াও তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা কর্মে ইতোমধ্যে সুধীমহলে সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছেন। লেখালেখি করেন অথবা সাহিত্যে, সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত হলেই তাঁকে সর্বজনীনভাবে গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে, এমন নয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন- লেখক-সম্পাদক মোহিত কামাল। ব্যক্তি হিসেবে তিনি খুবই সজ্জন। মোহিত কামাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬০ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। তাঁর পিতার নাম আসাদুল হক, মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বিভিন্ন পর্ব কেটেছে চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট শহরে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের পিতা। সন্তানদ্বয় স্ব-স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মোহিত কামাল চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করে এখন মনোচিকিৎসক হিসেবেই কর্মরত। অর্থাৎ, একাধারে তিনি মনোচিকিৎসক, মনোশিক্ষাবিদ, সাইকোথেরাপিস্ট। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট-এ প্রফেসর এ্যান্ড হেড অব সাইকোথেরাপি, একাডেমিক কোর্স ডিরেক্টর (সাইকিয়াট্রি) হিসেবে দায়িত্ব পালনরত। এসব কারণে তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহ খানিকটা বেড়ে যায়। এ রকম একটি ব্যস্ত কর্মজীবনে থেকেও তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট রয়েছেন। অবশ্যি পৃথিবীতে এ ধরনের উদাহরণই বেশি। অর্থাৎ, পেশা ও সৃজনশীল কর্মে ব্যবধান। প্রতিদিন কিছু লেখা, সামজিক যোগাযোগ রাখা, সাহিত্য আড্ডা মোহিত কামালের নিত্যকর্ম। ভিন্নভাবে বললে বলতে হবে- তিনি জীবনকে কর্মেই ব্যস্ত রেখেছেন। কর্মময় দিনযাপন ও সাহিত্যকর্মে নিবিষ্ট থাকাই তাঁর ব্যক্তি জীবনের মূল কথা। তাঁর পক্ষে কীভাবে সবকিছু সম্ভব হচ্ছে, এ জিজ্ঞাসায় আমাদের অবাক হতে হয়। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার পরিচালক রোকনুজ্জামান দাদাভাই আদর্শ ব্যক্তিত্ব। আগ্রাবাদ নবাঙ্কুর কচি-কাঁচার মেলার সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাহিত্যে বুনিয়াদ, সাহিত্যসত্তা গড়ে ওঠে শৈশবেই। মোহিত কামালের লেখালেখির শুরু তখন থেকেই। তবে প্রথম গল্পগ্রন্থ কাছের তুমি দূরের তুমি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে সময় প্রকাশন থেকে। এরপর থেকে তিনি লিখেই চলেছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পাশাপাশি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন সাহিত্য জগতে। জীবনের প্রতিদিনের সময় ঘণ্টাকে ভাগ করে কর্মজীবন ও সাহিত্য জীবনকে তিনি আলাদা করতে পেরেছেন। তাই উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে চলেছেন। মোহিত কামাল উপন্যাস ও গল্পই লেখেন বেশি। রয়েছে শিশুপাঠ্য রচনা। এছাড়া চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণাকর্ম রয়েছে। কেবল লেখা নয়, শব্দঘর-এর মতো একটি সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন। যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে। সংগঠক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং প্রবাল কচি-কাঁচার মেলার-সাবেক পরিচালক। বাংলা একাডেমির জীবন-সদস্য। জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিস্ট এ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ১২তম ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব সাইকিয়াট্রিস্ট ফেলোশিপ প্রোগ্রামে সেরা ফেলো নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর বৈচিত্র্যময় এক জীবন। ইতোমধ্যে মোহিত কামাল কথাসাহিত্যিক হিসেবে জনশ্রুতি অর্জন করেছেন। সাধারণ পাঠক তাঁকে সাহিত্য রুচির মানদন্ডেই গ্রহণ করেছেন, তা বলাইবাহুল্য। কথাসাহিত্যের বিষয় নির্বাচনেও তিনি মানবজীবনের সাম্প্রতিক সমস্যা, টানাপোড়েন, কিশোর-তরুণ বয়সের মনস্তত্ত¡কে বেশি গুরুত্ব দেন। সমকালীন জীবন ও সমাজের চালচিত্র কোন লেখকই অস্বীকার করেন না। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকরা সময় ও সমাজের বহির্জাগতিক বিষয়াবলি অঙ্কন করেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মানুষ বিভিন্ন উন্নয়নের সুযোগে যেমন জীবন আনন্দময় করতে প্রচেষ্টারত, তেমনি নতুন নতুন সমস্যায়ও জর্জরিত। প্রতিনিয়ত মানবসমাজকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিদ্যমান সমস্যাগুলো অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে। ওই সমস্যার প্রভাব ও এর প্রতিপাদ্য বিষয়ই তিনি পর্যবেক্ষণ করেন সাহিত্যে। মোহিত কামাল জীবনের বাহ্যিক, দৃশ্যমান সমস্যা উপস্থাপনের সঙ্গে মানবমনের জটিলগ্রন্থি উন্মোচনের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন- চিকিৎসাবিদ্যায় যেসব বিষয় চিকিৎসকের পরামর্শ হিসেবে গ্রহণের প্রচেষ্টা রয়েছে। সেসব বিষয়কে তিনি গল্পের মাধ্যমে ও তাঁর নির্মিত চরিত্রের মাধ্যমে রূপায়ণের প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে, তাঁর নির্মিত আখ্যানে আমরা শুধু গল্প পাঠ করি না, পরোক্ষে মনস্তত্ত¡ বিষয়ক সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিতও পেয়ে থাকি। তা ছাড়া এ ভার্চুয়াল জগতে মানবিক সম্পর্কের বিষয়গুলো বেশ জটিল। আমরা প্রতিনিয়ত এসব মোকাবেলা করতে চেষ্টারত। তবে বিশে^র দ্রæত পরিবর্তনে মানুষের প্রাত্যহিক আচরণেও বিবিধ পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ পরিবর্তন মানুষের বহির্জগতে ও মনোজগতে কী প্রভাব ফেলে ভাষার বর্ণনায় তিনি তা নিরীক্ষা করেন। এ নিরীক্ষা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। জীবনের কালপরিধি হিসেবে তাঁর লেখার পরিমাণ কম নয়। তাঁর রচনাসমূহের বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হয়- তিনি কথাসাহিত্যেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দুঃখময় ও বর্ণাঢ্য জীবনে এ পর্যন্ত ৫১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উপন্যাস ২২টি, গল্পগ্রন্থ ১২টি, শিশু ও অন্য বিষয়ক রচনা ১১টি। তিনি লিখেছেন শিশুপাঠ্য উপন্যাস- উড়াল বালক। লেখকের এ কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেন ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-এর পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচিতে SEQAEP কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো- লুইপা’র কালসাপ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৯), সত্যডানা সন্দেহপালক (অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৯), উপন্যাসসমগ্র ৩ জীবনঝঞ্ঝা (অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৯), উপন্যাসসমগ্র ২ চলার পথের ফাঁদ (অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৯) উপন্যাসসমগ্র ১ মনভুবন (অনিন্দ্য, প্রকাশ ২০১৯), চোরাগলি (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮), দুমুখা আগুন (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৮), সুস্মিতার বাড়ি ফেরা (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৭), বিষাদনদী (অন্যপ্রকাশ, ২০১৭), তবুও বাঁধন (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৭), চন্দন রোশনি (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৫), পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহŸর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪), আঁধারে আলোর ঢেউ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪), এক মলাটে পাঁচ উপন্যাস, মরুঝড় (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৩), পাথরপরান (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৩), অহনা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১২), ঘর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১১), চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) না, (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯), সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮), মায়াবতী (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৭), মন (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৬)। গল্পগ্রন্থ : চোখের ভেতর চোখ (গদ্যপদ্য ২০১৬), নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ, নেতার আসন গ্রহণ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৬), পৃথিবীতে কে কাহার (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১২), চাবি (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১১), আগুন কয়লায় পোড়া জীবন (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০), সন্দেহপ্রাচীর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯), উড়ালমন (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮), চাঁদমুখ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৭), জোছনা রাতে বাড়িয়েছি হাত (সময় প্রকাশন, ২০০১), কাছের তুমি দূরের তুমি (সময় প্রকাশন, ১৯৯৫)। কিশোর উপন্যাস : দুখু (অনিন্দ্য, ২০১৬), দুখু দ্বিতীয় খন্ড (অনিন্দ্য, ২০১৭), জাদুর বাকসে সোনার মোহর (অনিন্দ্য, ২০১৫), স্বর্ণজয়ী নীলচোখ (তাম্রলিপি, ২০১৪), উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২), বাবার শত্রু কম্পিউটার গেমস ছেলের শত্রু সিগারেট (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১১)। শিশুতোষ উপন্যাস : স্বপ্নডানা (অন্বেষা, ২০১৪), বন্ধু আমার বন্ধু (পাঠসূত্র, ২০১৩), শিশু-কিশোর সাহিত্য (গল্প) : হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্র যাত্রায় অদ্ভুত এক মাছের কান্ড (সময় প্রকাশন, ২০০৩)। মনস্তত্ত¡ : মানবমনের গতিপ্রকৃতি (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০১), মানবমনের উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৫), মনোসমস্যা মনোবিশ্লেষণ (অবসর, ২০০৫)। সম্পাদনা : বাংলাদেশের এ সময়ের তরুণদের ৩৫ গল্প (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৯), বাংলাদেশের তরুণদের ৩০ গল্প : বড়দের তরুণ বেলার ৩০ গল্প (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৮) লেখালেখির জন্য কয়েকটি পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছেন। এগুলো হলো- অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮; সিটি- আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪; এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১২; ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬; এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা এ্যাওয়ার্ড ২০০৮; বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮; সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। কথাসাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস সম্মাননা ২০১৮। বস্তুত, পুরস্কারই শেষ কথা নয়। মোহিত কামালের ক্ষেত্রেও তা সত্য। সারা বিশ্বে লেখালেখির মান নিয়ে সব লেখকের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। পাঠকের পছন্দ ও পাঠাভ্যাস সমান নয়। এ বৈচিত্র্যই জীবন ও সাহিত্যের মহৎ সৌন্দর্য। এ নান্দনিক কাজ না করেও একজন ব্যক্তি জীবন পরিচালনা করতে পারেন। একজন লেখক নিরন্তর লিখে চলেছেন, এর চেয়ে আর বড় কি হতে পারে। মোহিত কামাল নিয়ত তা-ই করেছেন। মোহিত কামালের জীবন-পরিধির ৬০তম এ জন্মদিনে তাঁর প্রতি পাঠক হিসেবে আমাদের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×