ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফারুক সুমন

কবিতার অদ্ভুত আনন্দ

প্রকাশিত: ০৮:২২, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

কবিতার অদ্ভুত আনন্দ

শিল্পের শাখায় কবিতা এমন একটি প্রবাহের নাম, যা নিয়ে লিখতে গেলে গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন। তবুও লিখতে ইচ্ছে করে। কবিতা নিয়ে যতই লিখি ততই আনন্দ পাই। অদ্ভুত আনন্দ। ভাষাহীন বোবা অনুভূতি কবিতা হয়ে ভর করে। সোনাদানা কিংবা উচ্চমার্গীয় কোন প্রত্যাশা নেই। তবুও একজন কবি শব্দের আরাধনায় কাটিয়ে দেন মূল্যবান একটি জীবন। শব্দ শস্যের সম্ভাবনায় কবির অপেক্ষার সীমা নেই। এখানে যেন কবি গেয়ে ওঠেন ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’ একজন কবি জীবনের সার্থকতার গান শুনতে পান বলেই কবিতায় খোঁজেন জীবনের স্ফুর্তি ও সম্ভাবনা। কবিতার জন্য, শুধু কবিতার জন্য কত বদনাম কবুল করে একজন কবি পথ চলেন। কবিতার পথে চলতে চলতে আমৃত্যু তিনি দহন মেনে নেন হৃদয় গহনে। কবির ভাষায় উপলব্ধি হয়ত এ রকম- ‘কবিতার জন্য কবুল করেছি অনেক বদনাম/ ভুল পথে হেঁটে গেছি এতোটাই দূরে যে/ প্রত্যাবর্তন কোনো অর্থই বহন করে না’ (খালেদ হোসাইন)।’ ধুলিমলিন বসনে কবি যাপন করেন নিখাদ মানুষের জীবন। তিনি অনুভব করেন পরিশেষ জীবনের গন্তব্য মূলত অনিশ্চিত। কৃত্রিম পোশাক কিংবা বেশভূষায় বাহ্যিক চাকচিক্যের জৌলুস থাকলেও মানবমুক্তির তরে অন্তরে গোপন আনন্দের উদ্ভাস ঘটাতে হবে। কবি স্বপ্ন দেখেন সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কবিতার বৃহৎ ভূখণ্ডজুড়ে তাই মানুষের জয়গান। মানবতার জয়গান। পৃথিবীতে হাজারও ভাষা আছে। সকল ভাষাতেই কবিতা রচিত হয়। কিন্তু ভাষা স্বতন্ত্র হলেও কবিদের জীবনযাপন ও জীবনদর্শন প্রায় নিকটবর্তী। পৃথিবীর মানচিত্রে যে অংশেই কবি অবস্থান করুন, অনুভব ও উপলব্ধির অঙ্গীকারে কবিরা যেন একই কান্নাহাসি সাঙ্গ করে বেঁচে আছেন। কবি মানেই ভিন্ন ভাবনার কেউ। কবি মানেই প্রবাহিত স্রোতের বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবি জানতে চান বাতাসের গতিপ্রকৃতি। মত ও পথের প্রাগ্রসর ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন বলেই সমকালে কবির ভাগ্যে জোটে উন্মাদের অভিযোগ। মহৎ কবি এসবের তোয়াক্কা করেন না। কারণ তিনি হয়ত অনুমান করতে পারেন পৃথিবীতে উদয়াস্তের সংজ্ঞা কী। হ্যাঁ, এটা এই অর্থে হয়ত উন্মাদনা। এখন রাত দু’টা বাজে। আমার ঘুম আসছে না। পাশে স্ত্রী আর ১০ মাসের সন্তান ঘুমাচ্ছে। কবি ও কবিতা নিয়ে এই মুহূর্তে আমার লিখতে ইচ্ছে করছে। আমি চুপিসারে সন্তর্পণে শয়নকক্ষ ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে বসে এই লেখা লিখছি। এটা কিছুটা উন্মাদের লক্ষণ বৈকি! আমি এটা লিখে আনন্দ পাচ্ছি। এটাই অদ্ভুত আনন্দ। ভাষাহীন বোবা উপলব্ধি। মাত্র একটি কালোত্তীর্ণ পঙ্ক্তি একজন কবিকে যুগের পর যুগ বাঁচিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে ১০০টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেলেও যদি তা কালোত্তীর্ণ না হয়; কিংবা পাঠকের অন্তরকে শিল্পরসে সিক্ত না করে, তবে তা সময়ের স্রোতে বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যাবে। কবির অভিমুখ শিল্পপানে। সময় এবং সময়জ্ঞান দুই বাহুতে ভর দিয়ে একজন কবিকে উড়তে হয় শিল্পাম্বরে। কবিতার মৌলিকতাই একজন মহৎ কবির শিল্পস্বরকে চিহ্নিত করে। ফলে প্রতিটি পঙ্ক্তি সৃষ্টিমুহূর্তে কবি বহন করেন শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার। তার কাছে একটি মনোগ্ধকর পঙ্ক্তির সৃষ্টি মানেই জীবনের সার্থক উন্মোচন। পৃথিবীর সকল মানুষই কবি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চমকে উঠেছেন এমন কথায়। এটা হয় কীভাবে? কবিতা হচ্ছে কবির অন্তর আহরিত বাণী বিন্যাস। আবেগ ও কল্পনার উচ্চমার্গীয় বহির্প্রকাশই কবিতা। আবেগ ও কল্পনা যদি কবিতার অন্যতম প্রধান রসদ হয়, তবে স্বভাবতই মানুষ কবি। কারণ প্রত্যেকটি মানুষ আবেগ ও কল্পনাকে আশ্রয় করে যাপন করে শিল্পজীবন। কেবল কাব্যিক ভাষা নেই বলে, অনুভবকে ছন্দোবদ্ধ ও আলঙ্করিক সৌন্দর্যে প্রকাশ করতে পারে না বলেই কবি অভিধা তাদের কপালে জোটে না। এ কারণেই, মানুষমাত্রই ভেতরে বোবা, ভাষাহীন এক কবিসত্তাকে লালন করে। কবিতা অদ্ভুত এক আনন্দদুয়ার অবারিত করে অনুরাগীর অনুভবে। আভাসে-ইঙ্গিতে, শব্দ- সৌন্দর্যে সাঙ্গীতিক মূর্ছনায়, উপমা ও চিত্রে তৈরি হয় কবিতার নান্দনিক ভুবন। যেখানে কবিতানুরাগী নিজের স্বপ্ন-কল্পনা, আবেগ, মেধা ও অভিজ্ঞতার স্তরানুযায়ী পরিভ্রমণ করে যখন তখন। যার ফলে ব্যক্তিভেদে কবিতার উপভোগ ও উপলব্ধিতে দেখা দেয় পার্থক্য। আর এটাই স্বাভাবিক। কবিতা এক ধরনের আশ্রয় বৈকি। মানুষের সুখ-দুঃখের বিবরণ প্রতীক ও ব্যঞ্জনাবহ শব্দরাজিতে মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতায়। ধরা- অধরার দোলাচলে মানুষ জীবনব্যাপী কবিতার রূপরসগন্ধকে অনুভবের চেষ্টা অব্যাহত রাখে আমৃত্যু। কিন্তু পায় কি? শিল্পের এই অতৃপ্তিই শিল্পের চ‚ড়ান্ত ক্ষমতা। কবিতা ভাবপ্রধান শিল্পমাধ্যম। ভাবপ্রধান বলেই কবিতায় সমর্পিত কবি এক ধরনের ঘোরের ভেতর নিমগ্ন থাকেন। একটি পঙ্ক্তির আশায়, একটি স্বপ্নময় শব্দের সন্ধানে কবি আপন অন্তরাত্মা সঁপে দিয়ে অস্থির অপেক্ষায় থাকেন। শুধু কবিতার অভিলাষে ছিপ ফেলে ঠায় বসে থাকেন ভাবের পুকুরে। অদৃশ্যলোকের শব্দ-প্রত্যাশায় স্বপ্নকল্পনায় মগ্ন হয়ে মনে মনে চলতে থাকে কবিতার জেকের। ব্যঞ্জনাবহ শব্দই কবির আরাধ্য। কেবল শব্দের আশায় দীনহীন জীবনযাপনে তার কোন আক্ষেপ নেই। শুধু কবিতার প্রেমে পড়ে মূল্যবান মানবজীবন উৎসর্গ করে শিল্পের ময়দানে। কবির এই উৎসর্গিকৃত অবস্থাকে লোকে- উচ্ছন্নে গেল বলে তিরস্কার করে। জা কিছু প্রচলিত, বিশেষ করে এলিট শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা নিজেদের উত্তম হিসেবে জাহির করার জন্য যে সকল বিধিবিধান জারি রেখেছে। একজন প্রকৃত কবি বরাবরই সে সবের বিরোধিতা করেন। এ কারণেই কখনও কখনও কবিকে উন্মাদ আখ্যা বরণ করে সমাজ কিংবা স্বদেশচ্যুত হতে হয়। একজন কবি তা-ই বলেন, যা কিছু মানুষ ও মানবতার পক্ষে। কবিকণ্ঠে তা-ই উচ্চারিত হয়, যা কিছু সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের । স্রষ্টার সৃষ্টিরাজির মাঝে কবি এক অনন্য স্রষ্টা। অকল্পনীয় দৃশ্যের উন্মোচন, অনাস্বাদিতপূর্ব অনুভবের আবিষ্কার, অনির্বচনীয় আনন্দের উৎসদুয়ার কেবল কবিই মেলে ধরতে আরেন ভাষাসৌকর্যে। এই কাজটি চিত্রশিল্পীও করে থাকেন রংতুলি হাতে। অনেকেই কবিদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে মাঝে মাঝে নাক সিঁটকান। ভাইরে, কবিতাই তো লেখে। মানুষ তো খুন করছে না। সমাজের সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কবির সংখ্যাধিক্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। একটি কবিতার জন্য হামাগুঁড়ি দেয় আবেগের শিশু। মৃত্তিকালগ্ন হয়ে গড়াগড়ি যায় ধূলিময় দিন। তবুও কবির অন্তহীন উৎসাহ। কবিও মাঝির মতো কবিতার দাঁড় টেনে অগ্রসর হন আগামীর অভিমুখে। মাঝির যেমন দাঁড়টানা হাতে কড়া পড়ে, কবিও কবিতার ধ্যানে ক্লান্তিহীন পরিব্রাজক। কবির কলিজায় কবিতার আরাধনায় স্বপ্নানন্দের কড়া পড়ে। কবিতার অপেক্ষায় কবির আক্ষেপ সীমাহীন। কবি বিশ্বাস করেন, তার হাতেই বুঝি সৃষ্টি হবে সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এই বিশ্বাস কবিকে স্বীয় লেখায় সচল রাখে। শৈশবের একটি ঘটনা মনে পড়ে। জোছনা শোভিত রাত। প্রচন্ড গরম পড়েছিল। আমাদের বাড়িতে তখনও বিদ্যুতের সংযোগ আসেনি বলে কেরোসিনের চেরাগ কিংবা হ্যারিকেনের আলো ছিল অন্ধকার বিদীর্ণ করার প্রধান ভরসা। গরম থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল হাতপাখা। তালপাতা অথবা বাঁশের বেতী দিয়ে অথবা কাপড়ের তৈরি পাখা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর ধীরে ধীরে জুড়িয়ে যেত। মা চাচিরা উঠানে বিছানা পেতে শুইয়ে দিতেন। সম্ভবত ফালগুন ও চৈত্র মাসে এমনটি বেশি হতো। যা হোক, বলছিলাম জোছনা শোভিত সেই রাতের কথা। তারাভরা ঝকঝকে আকাশ। মাঝেমাঝে ভাসমান মেঘ চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছিল। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদতারা খচিত শামিয়ানার নিচে। দেখছি শৈশবের স্বাপ্নিক চোখ দিয়ে। মনে মনে বুনে চলেছি আলোছায়ার নানা ছবি। হঠাৎ একটি আচানক নক্ষত্র খসে পড়লো আকাশ থেকে। এই দৃশ্য দেখে আমি স্তম্ভিত হলাম। শিহরিত হলো কৌত‚হলী মন। আমার অপেক্ষার অন্ত নেই। এই দৃশ্য আবার দেখতে চাই। রাতভর উঠানে শুয়েছিলাম আরও একটি নক্ষত্র পতনের আশায়। হায়! সে রাতে আর নক্ষত্রের পতন হলো না। পরের দিন কেটেছে আমার নক্ষত্র পতনের অপেক্ষায়। কখন সন্ধ্যা হবে, আর আমি উঠানে বিছানা পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকব আকাশ পানে। এভাবেই খসে পড়া নক্ষত্রের দৃশ্য দেখার বাসনায় কেটেছে অগণন রাত। এখন মনেহয়, একজন কবির অন্তরে শব্দপতন কিংবা পঙক্তির পতনও কিছুটা নক্ষত্রপতনের মতো। একটি শব্দ কিংবা পঙ্ক্তির উদয়নে কবি অস্থির হয়ে ওঠেন পরের শব্দ কিংবা পঙ্ক্তির অপেক্ষায়। দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে। কিন্তু কবির প্রতীক্ষার অন্ত নেই। কখন কৃপা হবে কবিতাদেবীর, নক্ষত্রপতনের ন্যায় শব্দপতন হবে কবির অন্তরাকাশে। ক্লান্তিহীন এই অপেক্ষা কেবল একজন কবিই করে থাকেন। এই ব্যাকুলতা শুধু ব্যঞ্জনাবহ শব্দের, অন্তর আহরিত শব্দের প্রত্যাশায়। এতেই কবির আনন্দ, অদ্ভুত আনন্দ।
×