ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। আর সমুদ্রতলের প্রাণীদের নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই অনেক আগে থেকেই। সমুদ্র তার বুকে লুকিয়ে রাখে অনেক অজানা বিস্ময়। সেই অজানার যতটুকুই মানুষ জানতে পেরেছে, ততটুকুই তাকে মুগ্ধ করেছে। সমুদ্রতলের প্রাণী বৈচিত্র্য বরাবরই মানুষকে

সাগরতলের বিস্ময়কর প্রাণী

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

সাগরতলের বিস্ময়কর প্রাণী

ম্যান্ডারিন মাছ সমুদ্র তার বুকে লুকিয়ে রাখে অনেক চমক। নীল রঙের এই মাছগুলো সেই চমকগুলোর একটা। অস্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরে মূলত এদের বসবাস। নীল রঙের শরীরে বিভিন্ন রঙের মিশেল। দেখে মনে হবে বুঝি কেউ রংতুলি দিয়ে মনের মতো আঁকাআঁকি করেছে নীল ক্যানভাসে। মেরুদÐী প্রাণীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত শুধু দুটি গোত্র পাওয়া গেছে যাদের দেহ রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণে নীল। ম্যান্ডারিন মাছ এদের মধ্যে অন্যতম। উজ্জ্বল রঙের কারণে এ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এদেরকে এ্যাকুরিয়ামে রাখাটা বেশ কঠিন, কেননা এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্যাভাসের কারণে সমুদ্রের বাইরে মানিয়ে নিতে পারে না। টিউব এ্যানিমোন টিউব এ্যানিমোনকে হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে বুঝি একটা ফুল ফুটে রয়েছে। এদের দেহ নলাকার। দেহ দেহ ঘিরে অসংখ্য কর্ষিকা থাকে। কর্ষিকাগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে থাকে যে দেখে ফুলের পাপড়ির মতো মনে হয়। টিউব এ্যানিমোন বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। বেগুনি, সাদা, বাদামি, গোলাপি, কমলাসহ নানা রঙের টিউব এ্যানিমোনের বসবাস সমুদ্রের তলদেশে। সমুদ্রের বিস্ময়গুলোর তালিকায় নিঃসন্দেহে স্থান পাবে এই প্রাণীটি। এই প্রাণীটিও এ্যাকুরিয়ামে রাখার জন্য বেশ জনপ্রিয় একটি প্রাণী। এরা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে বেশ সহজেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে বলে এ্যাকুরিয়ামের পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না তাদের। মজার বিষয় হলো, এরা ভয় পেলে বা বিপদে পড়লে সব কর্ষিকা গুটিয়ে নিয়ে শুধু একটা নলের মতো আকৃতিতে পরিণত হতে পারে। ফ্লেমিংগো টাং স্নেইল এরা এক ধরনের সামুদ্রিক শামুক। তবে শামুক বলতে আমরা যা বুঝি এই প্রাণীটি কিন্তু মোটেই তেমন নয়। নর্থ ক্যারোলিনা থেকে ব্রাজিলের তীর পর্যন্ত পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরে এদের বসবাস। উজ্জ্বল হলুদাভ গায়ের রং। তবে এই প্রাণীটি আপনাকে চিতাবাঘের কথা মনে করিয়ে দেবে, কেননা এদের সারা গায়ে উজ্জ্বল রঙের ছোপ থাকে। অন্যান্য শামুকের মতো ফ্লেমিংগো টাং স্নেইলেরও শক্ত খোলস থাকে। তবে উজ্জ্বল হলুদ-কমলা রংটা কিন্তু খোলসে থাকে না। কখনও আক্রমণের শিকার হলে তারা তাদের খোলসের অংশ অনাবৃত করে। এরা সাধারণত সমুদ্রের উপরের দিকেই থাকে। সমুদ্র থেকে সর্বোচ্চ ২৯ মিটার নিচে এদেরকে পাওয়া গেছে। এদের উজ্জ্বল রংকে খোলসের রং ভেবে পর্যটক ও স্কুবা ডাইভাররা প্রায়ই এই প্রাণীটি সংগ্রহ করে থাকেন, যার ফলে এদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে। ব্লু ট্যাং এই মাছটিও সমুদ্রের অন্যতম সুন্দর একটি মাছ। এদের শরীরও নীল রঙের হয়ে থাকে। লেজে থাকে হলুদ রং আর গায়ে থাকে কালো রঙে ‘প্যালেট’ ডিজাইন। এরা ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ব্লু ট্যাং-এর দেহ প্যানকেকের মতো চ্যাপ্টা থাকে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে এই মাছটি পাওয়া যায়। ফ্লিপাইনস, জাপান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় অথবা ৮-১৪টি মাছের ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। উজ্জ্বল রঙের জন্য এরাও এ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ম্যান্টিস শ্রিম্প চিংড়ি আমাদের সবারই খুব পরিচিত প্রাণী। ম্যান্টিস শ্রিম্প কিন্তু এক ধরনের সামুদ্রিক চিংড়ি। কিন্তু আমাদের পরিচিত চিংড়ির সঙ্গে গঠনে মিল থাকলেও রঙের ভিন্নতা এদেরকে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪৫০ প্রজাতির ম্যান্টিস শ্রিম্পের সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে পিকক ম্যান্টিস শ্রিম্প বেশ জনপ্রিয় এদের রঙের জন্য। উজ্জ্বল সবুজ এবং লাল রঙের মিশেল এদের শরীরে। পিঠের দিকটা সবুজ এবং শরীরের নিচের অংশ লাল রঙের হয়ে থাকে। শরীরের উপরের অংশে মাথার দিকে সবুজ রংটা হলুদাভ হয়ে এসেছে। ম্যান্টিস শ্রিম্প সাধারণত লম্বায় ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। সমুদ্রে থাকলেও এরা খুব বেশি গভীর পানিতে বসবাস করে না। আরেকটা মজার তথ্য হলো, আকারে ছোট হলেও ম্যান্টিস শ্রিম্প কিন্তু সমুদ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদের নখর প্রচন্ড শক্তিশালী। লিফি সি-ড্রাগন দেখতে পাতার মতো বলেই এই প্রাণীটির নামটি এমন। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিম উপক‚লে এই প্রাণীটি দেখা যায়। এদের শরীরের দু’পাশ থেকে পাতার মতো অংশ বেরিয়ে এসেছে। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই পাতার মতো অংশগুলো প্রাণীটিকে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এই পাতার মতো অংশগুলো এদেরকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে সাহায্য করে। এগুলোর কারণে প্রাণীটিকে সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো দেখায়। লিফি সি-ড্রাগনের গায়ের রং সাধারণত বাদামি বা হলুদ হয়ে থাকে। ক্লাউনফিশ ‘ফাইন্ডিং নিমো’ নামক জনপ্রিয় এ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন, তারা ক্লাউনফিশের সঙ্গে পরিচিত। চলচ্চিত্রটিতে নিমো নামের যে মাছটিকে দেখা যায়, সে কিন্তু ক্লাউনফিশ প্রজাতিরই মাছ। এই মাছগুলোর দেহের রং কমলা। কমলা রঙের উপরে থাকা সাদা রঙের নকশা। এরা লম্বায় ১১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভারতীয় মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের ঠান্ডা পানিতে এদের বসবাস। ব্লু ড্রাগন এই প্রাণীটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বøু ড্রাগন ছাড়াও এর একটি জনপ্রিয় নাম বøু এ্যাঞ্জেল। এই প্রাণীটির দেহের রং নীল এবং রুপালি। এরা উলটো হয়ে সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকে। দেহের নীল অংশটি সমুদ্রের উপরের নীল পানির সঙ্গে মিশে থাকে এবং রূপালি অংশটি সমুদ্রের নিচের রুপালি পানির সঙ্গে মিশে থাকে। এরা লম্বায় ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই সমুদ্রের পানিতে এদের উপস্থিতি দেখা গেছে। বøু ড্রাগন যখন তাদের দেহটি সম্পূর্ণভবে সম্প্রসারিত করে, তখন তাদের দেখতে অনেকটাই ভিনগ্রহের এ্যালিয়েন ড্রাগনের মতো লাগে। তবে অসম্ভব সুন্দর এই প্রাণীটি সমুদ্রের ‘বিউটিফুল কিলার’ নামে পরিচিত, কেননা এরা বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে নিজেদের চেয়ে অনেক বড় প্রাণীকেও ঘায়েল করতে পারে। রয়াল স্টারফিশ স্টারফিশ বা তারামাছ খুব পরিচিত একটি সামুদ্রিক প্রাণী। কিন্তু রয়াল স্টারফিশ সাধারণ তারামাছের চেয়ে আলাদা এদের ব্যতিক্রমী রঙের জন্য। এদের শরীর বেগুনি রঙের, সঙ্গে রয়েছে কমলা রঙের মার্জিন। এদের শরীর অন্যান্য স্টারফিশের মতোই পাঁচটি বাহুতে বিভক্ত, যার একেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ২ থেকে ৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মূলত ক্যারিবীয় অঞ্চলে দেখা যায়। ডিসকাস ফিশ সমুদ্রের এক বৈচিত্র্যময় প্রাণী ডিসকাস ফিশ। এদের রং এবং আকৃতির বৈচিত্র্য যে কাউকেই বিস্মিত করবে। ডিসকাস ফিশ বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে। কোন প্রজাতির মাছের শরীরে লাল-সাদার মিশেল, আবার কোন প্রজাতিতে উজ্জ্বল নীল আর বাদামির মিশেল। সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে এই মাছ পাওয়া যায়। রং ও আকৃতির বৈচিত্র্যের কারণে এ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে এরা দারুণ জনপ্রিয়।
×