ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর রেণু

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর রেণু

(গত মঙ্গলবারের পর) আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই যোগাড় করার চেষ্টায় থাকত। শেষ পর্যন্ত আব্বা আমাকে টাকা দিলেন, খুব বেশি টাকা দিতে পারেন নাই, তবে আমার চলবার মতো টাকা দিতে কোনদিন আপত্তি করেন নাই। আমার নিজের বেশি কোন খরচ ছিল না, একমাত্র সিগারেটই বাজে খরচ বলা যেতে পারে। আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোন টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। যুক্তফ্রন্ট এই পটপরিবর্তনে হক সাহেবের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করবে এই সময় বঙ্গবন্ধু লিখেন “আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশিই হলাম, আমি তো মোসাফিরের মতো থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জানে, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। আমি হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ‘তোকে মন্ত্রী হতে হবে। আমি তোকে চাই, তুই রাগ করে ‘না’ বলিস না। তোরা সকলে বসে ঠিক কর, কাকে কাকে নেয়া যেতে পারে।” আমি তাঁকে বললাম, ‘আমাদের তো আপত্তি নাই।’ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর তিনি লিখেন, “রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছলাম। শপথ নেয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।” মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা, আমরা আত্মজীবনীতে দেখি,- ‘বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙ্গে দেবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হলো না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছ।’ রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এলো, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর, আর এনএম খানকে চীফ সেক্রেটারি করা হয়েছে।’ এরপর তিনি আরও লিখেন- “আমি রেণুকে বললাম, ‘আবার আসলে বলে দিও শীঘ্র আমি বাড়িতে পৌঁছাব।’ বিদায় নেয়ার সময় অনেককে বললাম, ‘আমি তো জেলে চললাম, তবে একটা কথা বলে যাই, আপনারা এই অন্যায় আদেশ নীরবে মাথা পেতে মেনে নেবেন না। প্রকাশ্যে এর বাধা দেয়া উচিত। দেশবাসী প্রস্তুত আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের। জেলে অনেকের যেতে হবে, তবে প্রতিবাদ করে জেল খাটাই উচিত।’ সেখান থেকে এসে পথে কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করলাম, কাউকেও পাওয়া গেল না। আমি সরকারী গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিক্সা ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওনা করলাম। দেখলাম, কিছু কিছু পুলিশ কর্মচারী আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আমি রিক্সায় পৌঁছালাম, তারা বুঝতে পারে নাই। রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, ‘আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন।’ তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো হুকুমের চাকর। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য বারবার টেলিফোন আসছে।’ আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, ‘তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও। বিনা দ্বিধায় বঙ্গবন্ধু ও রেণু ছেড়ে দিচ্ছেন মন্ত্রিত্ব এর জন্য কোন আক্ষেপ নেই রেণু’র, বরং জেলে যাওয়ার বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছেন পরম মমতায়।” “রেণু টেলিগ্রাম পেয়েছে। আব্বার শরীর খুবই খারাপ, তাঁর বাঁচবার আশা কম। ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা করবে আব্বাকে দেখতে। একটা দরখাস্তও করেছে সরকারের কাছে, টেলিগ্রামটা সঙ্গে দিয়ে। তখন জনাব এনএম খান চীফ সেক্রেটারি ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি আমাকে ¯েœহ করতেন। রাত আট ঘটিকার সময় আমার মুক্তির আদেশ দিলেন।” এর পরের ঘটনায় তিনি লেখেন- ‘আমি জেলগেট পার হয়ে দেখলাম, রায়সাহেব বাজারে আমাদের কর্মী নুরুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, “ভাবি এই মাত্র বাড়িতে রওনা হয়ে গেছে, আপনার আব্বার শরীর খুবই খারাপ। তিনি বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে উঠেছেন। জাহাজ রাত ১১টায় নারায়ণগঞ্জ পৌঁছবে। এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি রওনা করলে নারায়ণগঞ্জে যেয়ে জাহাজ ধরতে পারবেন।” তাকে নিয়ে ঢাকার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কারণ, পূর্বে এ বাড়ি আমি দেখি নাই। আমি জেলে আসার পরে রেণু এটা ভাড়া নিয়েছিল। মালপত্র কিছু রেখে আর সামান্য কিছু নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছুটলাম। তখনকার দিনে ট্যাক্সি পাওয়া কষ্টকর ছিল। জাহাজ ছাড়ার পনেরো মিনিট পূর্বে আমি নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছলাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালেও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নেই। রেণু ঐশ্বরিক সহ্য শক্তি নিয়ে সোনার বাংলা সৃষ্টির জন্ম, যন্ত্রণাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। জেলে থাকাবস্থায় আত্মজীবনীর ১৭১ পাতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি একটা ফুলের বাগান করেছিলাম। আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল।’ যে প্রেমিকের জীবন ঘিরে থাকে রেণু আর রেণুর প্রেম- কবি বলেন তার উজাড় হওয়া বাগানেও হাওয়া ফুল ফোটায়। (সমাপ্ত) লেখক : আইনজীবী
×