ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাদাসিধে কথা ॥ এই গ্লানি কোথায় রাখি?

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

সাদাসিধে কথা ॥ এই গ্লানি কোথায় রাখি?

আমি প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর পত্র-পত্রিকায় লিখি। এই সপ্তাহের জন্যও লিখতে বসেছিলাম। সবেমাত্র একটা ইলেকশন শেষ হয়েছে। মোটামুটি সবাই জানত আওয়ামী লীগের মহাজোট জিতে আসবে; কিন্তু ফলাফল দেখে আমরা সবাই কম-বেশি চমকে উঠেছি। সত্যি সত্যি দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে গিয়েছে, নাকি এর মাঝে অতি উৎসাহী মানুষের অবদান আছে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। একটা জিনিস স্পষ্ট- এই দেশে এখন মানুষ মন খুলে কথা বলতে ভয় পায়, পত্র-পত্রিকাও যথেষ্ট সতর্ক। সবকিছু মিলিয়ে আমি আমার নিজের মতো করে কিছু একটা লিখে প্রায় শেষ করে এনেছি- তখন হঠাৎ করে সংবাদপত্রে একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল। নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকাতে চার সন্তানের জননীকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য গণধর্ষণ করা হয়েছে। (আজকাল প্রায়ই গণধর্ষণ শব্দটি চোখে পড়ে; কিন্তু এখনও আমি এটাতে অভ্যস্ত হতে পারিনি, বাংলা ভাষায় এর চাইতে ভয়ঙ্কর কোন শব্দ আছে কি-না তা আমার জানা নেই।) ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত বিজয়ী হওয়ার পর আমরা অনেকবার এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম সেটি এখন অতীত। এখন এটি আর কখনও ঘটবে না। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর এটি ঘটেছে এ রকম শুধু একটি ঘটনার খবরই এসেছে। কিন্তু একটি ঘটনাই কেন ঘটবে? খুবই স্বাভাবিকভাবে সেই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন যোগাযোগ নেই। ধর্ষিতা জননী কিন্তু তা বলছেন না, তিনি রুহল আমীন নামে সুনির্দিষ্ট একজন মানুষের নাম উল্লেখ করে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তার নিরক্ষর স্বামী, স্কুল পড়ুয়া মেয়েসহ সবাইকে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণ করার জন্য দশ-বারোজন বাইরে নিয়ে গেছে। আমি কী অবলীলায় বাক্যটি লিখে ফেললাম? কিন্তু কেউ কী কল্পনা করতে পারবে এই বাক্যটিতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেটি কী ভয়ঙ্কর? রুহুল আমীন নামক যে মানুষটির নির্দেশে এই ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধর্ষিতা জননী অভিযোগ করেছেন তাকে বাঁচিয়ে নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ বলছে এই ঘটনাটির সঙ্গে রাজনীতি বা নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই, এটি বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। আমরা কেন ধর্ষিতা জননীর কথা বিশ্বাস না করে পুলিশের কথা বিশ্বাস করব? নোয়াখালীর সুবর্ণচরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের একজন নিরক্ষর স্কুটার চালকের স্ত্রী নিশ্চয়ই গুরুত্বহীন এক মানুষ। যার নির্দেশে প্রায় এক ডজন মানুষ এই গুরুত্বহীন এক জননীকে ধর্ষণ করে সে নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতাশালী। নির্বাচনে বিজয়ের পর সে নিশ্চয়ই নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছে। কাজেই তুচ্ছ একজন মহিলাকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য এ রকম একটি শিক্ষা দেয়া নিশ্চয়ই খুবই মামুলি ব্যাপার, এটা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হওয়াটাই হয়ত বিস্ময়কর। কিন্তু সদ্য বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য এটি একটি গ্লানি। গ্লানিটি তুচ্ছ নয়। এই গ্লানি আকাশছোঁয়া। সদ্য নির্বাচিত রাজনৈতিক দলটি সরকার গঠন করে সবার আগে এই গ্লানি থেকে তাদের মুক্তি পেতে হবে। ধর্ষিতা এই জননী, তার নিরক্ষর স্বামী, স্কুল পড়ুয়া অসহায় কয়েকটি ছেলেমেয়ে যতক্ষণ আমাদের ক্ষমা না করবে ততক্ষণ আমরা কিছুতেই গ্লানিমুক্ত হতে পারব না। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই বিচলিত এবং বিষণ্ণ। আমি কিছু লিখতে পারছি না। পাঠকেরা আমাকে ক্ষমা করবেন। ০২-০১-২০১৯
×