ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র-নজরুলের মানবমুক্তির চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

  রবীন্দ্র-নজরুলের মানবমুক্তির চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অনেক বিষয়েই পরস্পরের কাছাকাছি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এবং সে নৈকট্য কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। দু’জনেরই প্রধান পরিচয় যে তারা কবি। নিজেদের তারা ওভাবেই দেখতেন, লোকেও তাদেরকেই সেভাবেই দেখে। তারা দু’জনেই আবার ছিলেন বহুমুখী। সাহিত্যের সব শাখাতেই তাদের কাজ আছে এবং দেশের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সমাজের অগ্রগতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মানব মুক্তির চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক। এভাবেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন করলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে ‘রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং তার পরে’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। পথচলার ৬৭ বছর পেরিয়ে ৬৮ বছরে পদার্পণ করল বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার নানা আয়োজনে সজ্জিত ছিল নিমতলীর সোসাইটি প্রাঙ্গণে। সোসাইটির সদস্যদের প্রাণবন্ত আড্ডার পাশাপাশি ছিল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর একক বক্তৃতা। একইসঙ্গে আনন্দময় উপলক্ষের দিনটিতে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। সকালে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা। এরপর সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম ও সাধারণ সম্পাদক ড. সাব্বীর আহমেদ শান্তির প্রতীক সাদা কবুতর ও বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে ‘রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং তার পরে’ শীর্ষক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মারক বক্তৃতা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সম্পর্ক, সম্পর্কের পটভূমি এবং ওই দুই কবির প্রস্থানের পরের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করেন। সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক ড. সাব্বীর আহমেদ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎ কবি। বাংলার কবিদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশ্বসাহিত্যে গীতি কবিতার ক্ষেত্রে এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের তুলনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তবে লক্ষ্য করার বিষয়টি হচ্ছে নজরুলও মহৎ এবং বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রতিভা ও অর্জনের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পরেই তার স্থান। প্রথম ও দ্বিতীয়র মধ্যে দূরত্ব অবশ্য দুর্লঙ্ঘ্য। কিন্তু তারা একে অপেরর থেকে পৃথক, মহত্ত্বই তাদেরকে পৃথক করে দিয়েছে। স্মরণে রাখার মতো বিষয় হলো- নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন ছিল মাত্র ২২ বছরের, রবীন্দ্রনাথের সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই দুই কবি অনেক বিষয়ে পরস্পরের কাছাকাছি ছিলেন, সে নৈকট্য কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। দু’জনেরই প্রধান পরিচয় যে তারা কবি। নিজেদেরকে তারা ওভাবেই দেখতেন, লোকেও তাদেরকে সেভাবেই দেখে। তারা দু’জনেই আবার ছিলেন বহুমুখী। সাহিত্যের সব শাখাতেই তাদের কাজ আছে। রবীন্দ্রনাথের মতোই নজরুলের ছিল সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাদের অবদান অসামান্য। বাংলা সাহিত্যে তাদের মতো সঙ্গীতমনস্ক আর কোন কবি পাওয়া যায়নি। তারা দেশের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, সমাজের অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি নিয়ে তাদের চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক। তিনি আরও বলেন, সাহিত্য আরও অনেক কিছুর ভেতরে রুটিও তৈরি করে দেয়। উদারনীতিক সেই রুচির সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিনিধি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ওই রুটিই স্থায়ী হয়ে আছে। নজরুল যে একটা ভিন্ন রুচি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন সেটি পেছনে হটে গেছে। সাহিত্য ভদ্রলোকেরাই লেখেন এবং পড়েন। শিক্ষা সর্বজনীন হয়নি। শিক্ষিত ব্যক্তিরা যতটা না মানবিক হতে চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে ভদ্রলোক হওয়ার। ভদ্রলোকদের রাজত্বে নজরুলের গান তবুও চলে, তার সাহিত্য কদর পায় না। মনে হয় কেমন যেন গরিব গরিব, আবার উচ্চকণ্ঠও, অর্থাৎ অভদ্র। পিতৃতান্ত্রিক এই ব্যবস্থায় বিপ্লব যা করবার শরৎচন্দ্রের সব্যসাচীরাই করেছে, নজরুলের সব্যসাচীরা পারেনি। পরাজয়টা নজরুলের একার নয়, দেশের শতকরা আশিজন সুযোগ বঞ্চিত মানুষেরই। এশিয়াটিক সোসাইটির ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকে সর্বসাধারণের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর উন্মুক্ত করা হয়েছে। গতকাল সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম এক হাজার টাকা দিয়ে ৫০টি টিকেট ক্রয় করে জাদুঘর পরিদর্শনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। উক্ত ৫০টি টিকেট উপস্থিত সম্মানিত সদস্যদের জন্য প্রদান করা হয়। এছাড়া ঐতিহ্য জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়ক অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদও ৫০টি টিকেট ক্রয় করে দর্শকদের সৌজন্য উপহার প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবউন নেছা দুইটি এবং নারায়ণগঞ্জের আলহাজ মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া একটি নিদর্শন উপহার প্রদান করেন। সাধারণ দর্শকদের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুক্রবার বেলা একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত নামাজের বিরতি। জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য দর্শকদের প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা, ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে ১০ টাকা এবং বিদেশী দর্শকদের জন্য ২০০ টাকা।
×