ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফিল্ম উইদিন এ্যা ফিল্ম

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৩ জানুয়ারি ২০১৯

ফিল্ম উইদিন এ্যা ফিল্ম

‘এ দেশের যে শহরটা, শুনে থাকি বারুদে ঠাসা, তার নাম কলকাতা। আমি কলকাতার মানুষ। আমি কলকাতার মিছিলে সামিল হয়েছি বার বার। মিছিলে আওয়াজ তুলেছি। হাজার লক্ষ গলার সঙ্গে গলা মিলিয়েছি। প্রতিবাদ করেছি। লড়াকু কলকাতার আগুনে আমিও উত্তপ্ত হয়েছি।’ সত্তরের দশকের গোড়ায় এমন বক্তব্য পেশ করেছিলেন মৃণাল সেন। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকে রবিবার সকালে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের বুকে এই লড়াইয়ের স্পন্দন ধরে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর স্বকীয়তা তিনি বজায় রেখেছিলেন তাঁর প্রতিটি কর্মে। ভঙ্গুর সময়েও কমিউনিজমের প্রতি মৃণাল সেনের ভালবাসা এতটুকু কমেনি। তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের বাঙালী ফিল্ম মেকার, যিনি শূটিং চলাকালীন লাঞ্চ করতেন সবার সঙ্গে, এমনকি জুনিয়র টেকনিশিয়ানদের সঙ্গেও। কোন প্রকার বৈষম্যে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর কাছে সবাই সমান। আসলে তিনি ছিলেন প্র্যাকটিসিং সোশ্যালিস্ট। যদিও কোন দিন কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না, তবু শেষ দিন পর্যন্ত বামপন্থীদেরই সমর্থন করেছেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ফিল্ম উইদিন এ্যা ফিল্ম’ যে স্ট্রাকচার, সেটা ‘আকালের সন্ধানে’র মতো পাওয়ারফুল আর কোন বাংলা ছবিতে আছে বলে মনে হয় না। যখন ‘অটোগ্রাফ’ তৈরি করি, সেই ফিল্ম উইদিন এ্যা ফিল্মের স্ট্রাকচার আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।’ মৃণাল সেনের সিনেমা দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে পরিচালক প্রতিম ডি গুপ্তার ওপর। প্রতিম বলেছেন, ‘দূরদর্শনে একটা ইন্টারভিউ দেখেছিলাম।’ সেখানে উনি বলেছিলেন, ‘আমি ছবি তৈরি করি না পর-পর বাড়ি কেনার জন্য। ছবি তৈরি করি আমার যা বলার আছে, সেটা বলার জন্য...।’ আজকে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মার্কেট সেকশনে পরিচালকদের ছবি গেলেও তাঁরা লাফান। কিন্তু উনি কানের জুরি ছিলেন। তাঁর ছবি সেখানে দেখানো হয়েছে মাঝে মাঝেই। তাই মনে হয় মৃণাল সেন যতই ওভারশ্যাডোড বাই সত্যজিৎ রায় হন, উনি নিজের পরিধিতে বাঘ ছিলেন। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় যোগ করছেন, ‘মৃণাল সেনের ছবি তৈরির দর্শন আইপিটি-এর দর্শন। সে দর্শনে আমিও বিশ্বাসী। তাই অবশ্যই মৃণাল সেনের দ্বারা প্রভাবিত। আর্টহাউজ সিনেমার বিকাশ তাঁর হাত ধরেই হয়েছে। তাঁর উত্তরাধিকার নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করি।’ সিনেমার ফর্ম নিয়ে পরিচালক মৃণাল সেন যে লাগাতার এক্সপেরিমেন্ট করে গিয়েছেন, তা প্রভাবিত করেছে পরিচালক অতনু ঘোষকে। বলেছিলেন, ‘গত বছর একটি তামিল ছবি দেখে। নাম ‘টু লেট’। বাড়ি বদলের গল্প। সেখানে এক চরিত্র যখন বাক্স থেকে দুটি ডিভিডি বের করে, দেখে একটি ‘ভুবন সোম’, অন্যটি ‘আকালের সন্ধানে।’ তখনই আমার মনে হলো, যে মানুষটাকে আমরা অন্য দুটি নামের পাশে বসিয়ে আমাদের কাজ সেরে ফেলেছি, যদিও সেই দুই নাম মস্তবড়, তা-ও এই পরিচালকের জায়গা একেবারে আলাদা। তাঁর ছবি যে পুরনো দিনের সমাজের দলিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব দিক থেকে, তার উদাহরণ হিসেবে ছবির তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু তার বাইরেও ফর্ম নিয়ে তাঁর যে এক্সপেরিমেন্ট, তা ভারতীয় ছবিকে এগিয়ে দিয়েছে। নির্দিষ্ট চিত্রনাট্য বা সংলাপে তাঁর ছবি সীমাবদ্ধ থাকত না। আমাকে ভীষণভাবে ভাবায় যে দর্শন, ‘আপনাকে এক্সপেরিমেন্ট করে যেতেই হবে, হয় আপনি সারভাইভ করবেন, না হলে হারিয়ে যাবেন’। আর বাস্তববাদী সিনেমার যে ট্রেন্ড এখন চলছে, তার সঙ্গে মৃণাল সেনের ছবির দর্শন মিলে যায়।’ পরিচালক অরিন্দম শীল বলছেন, ‘আমাকে প্রভাবিত করে ওনার আঁতলামি না-করে একেবারে শিকড় থেকে একটি বিষয় তুলে ধরার ক্ষমতা, তার মধ্যে যে ‘র’ ব্যাপারটা রয়েছে সেটা। অর্থাৎ ভীষণ রিয়েলিস্টিক ফিল্মমেকিং। আজকে অভিভাবকশূন্য লাগছে। কারণ সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেনই ভারতীয় ছবির অন্যতম দুই প্রধান মুখ। অঞ্জন দা মৃণাল সেনকে নিয়ে যে ডকুমেন্টারি করছেন, সেটা দেখতে চাই।’ পরিচালক মৈনাক ভৌমিকও তীব্রভাবে প্রভাবিত। বললেন, ‘মৃণাল সেনের ছবিতে আপোসহীন সত্যিকে তুলে ধরা হয়েছে। ভারতবর্ষেও ছবি মানেই বিনোদনের বাইরে আমরা কিছু বুঝি না। কিন্তু সেই গল্প বলাকে উনি ভেঙেছেন। যেমন ‘ভুবন সোম’-এ জাম্প কাট বা হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা। সিনেমা অডিয়েন্স ফ্রেন্ডলি হওয়ার বাইরেও সেই মিডিয়ামকে অন্যভাবে ব্যবহার করা যায়, তা দেখিয়েছেন মৃণাল সেন। মৃণাল সেন ইতিহাসের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। এক সময় বাঙালীর মধ্যে কোন আদর্শবাদ ছিল না। তারপর ব্রিটিশ ইনফ্লুয়েন্স থেকে বেরনোর পর বাঙালীর মধ্যে মার্কসিজম তৈরি হলো। আবার ‘মহাপৃথিবী’-তে রয়েছে সেই আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পুরোটাই তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে রয়েছে। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করেন উনি। আমার কাছে তাই বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ম মেকার মৃণাল সেন।’
×