ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেশকিছু বাংলাদেশী গ্রেফতার

মাধ্যমিক পার হয়নি, কিন্তু ভার্সিটিতে পড়তে মালয়েশিয়ায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩ জানুয়ারি ২০১৯

মাধ্যমিক পার হয়নি, কিন্তু ভার্সিটিতে পড়তে মালয়েশিয়ায়

ফিরোজ মান্না ॥ দেশে মাধ্যমিক স্কুল পার হতে পারেননি। অথচ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ছাত্র ভিসায় মালয়েশিয়া গেছেন। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে ছাত্র ভিসায় মালয়েশিয়া গিয়ে তাদের বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তারা কর্মী হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ নিয়েছেন। কেউ কেউ খাবার হোটেলেও কাজ করছেন। অবৈধ এসব ছাত্রদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার পুলিশ গ্রেফতার অভিযান শুরু করেছে। গত দুই দিনে বেশ কিছু অবৈধ ছাত্র আটক করেছে দেশটির পুলিশ। আটকদের দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে বৈধ ছাত্রদের বেলায় কর্তৃপক্ষ কোন প্রকার হয়রানি করছে না। সূত্র জানিয়েছে, মাধ্যমিক স্কুল পার হননি এমন কয়েক হাজার ছাত্র বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন। তারা মালয়েশিয়ায় গেছেন স্টুডেন্ট ভিসায়। কিন্তু কোন ক্লাসে পড়তে এসেছেন তাও তারা জানেন না অনেকে। দালালের মাধ্যমে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় চুক্তি করে বছর দুয়েক আগে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যান। এমন বহু ছাত্র মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন হোটেলসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে অল্প বেতনে কাজ করছেন। এসব অছাত্র কলেজে কখনই যাননি। তারা অবৈধভাবে কাজ করায় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো শুরু করেছে। এ কারণেই বাংলাদেশীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব বাড়ছে মালয়েশিয়ানদের। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে ছাত্র ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার জন্য দূতাবাসের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে। দালালদের মাধ্যমে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় শুধু ছাত্র ভিসায়ই যাচ্ছেন না। ভিজিট বা ভ্রমণ ভিসাতেও অনেকে গিয়ে আর দেশে ফেরেননি। তারাও কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। ভ্রমণ ভিসায় এসে কর্মী হিসেবে হোটেলে কাজ নিয়েছেন। এরকম কয়েকজন ভ্রমণ ভিসাধারীকে পুলিশ আটক করেছে। দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুর নেমেই তারা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শহরে। ঢাকার কয়েক দালাল ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার চুক্তি করে মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসে তাদের। পরে চুক্তি অনুযায়ী টাকাও নিয়ে নেয়। পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে দালালরা আর কোন সাহায্যের হাত বাড়ায় না। মালয়েশিয়ায় যে দালাল চক্র রয়েছে তারা তখন তাদের চেনে না। এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে ছাত্র ও ভিজিট ভিসায় যারা মালয়েশিয়ায় গেছেন। এদিকে মালয়েশিয়া সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়া সরকারের চালু করা ‘মেগা থ্রি’ স্কিমের আওতাতেও যে কেউ ইমিগ্রেশনে ৪ শ’ রিঙ্গিত জমা দিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। বহু কর্মীর এই পরিমাণ টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই। ফলে অবৈধ কর্মীরা নানাভাবে দেশটিতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করছেন। তারা পুলিশের ভয়ে রাতে জঙ্গলে থাকছেন। গত বছরের ৩০ জুন বৈধ হওয়ার ‘রিহ্যায়ারিং’ কর্মসূচীর শেষ দিন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০ হাজারের বেশি অবৈধ কর্মীকে আটক করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। আটক অভিযান চলমান রয়েছে। আটককৃতদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে বাংলাদেশের দুই থেকে আড়াই লাখ কর্মীকে দেশে ফিরে আসতে হতে পারে। কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ব্যাপক হারে বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। ওই দুই বছরে দেশটিতে পাঠানো হয় ৪ লাখ ৪ হাজার ৯৬৩ জন কর্মী। এরপর থেকেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ধস নামতে শুরু করে। ২০০৯ সাল থেকে অন্যতম শ্রমবাজারটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে সরকারী পর্যায়ে (জিটুজি প্লাস) আবারও বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে দেশটি। মালয়েশিয়া সরকার পাঁচটি খাতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়। দু’দেশের মধ্যে এ বিষয়ক চুক্তি হয় ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু চুক্তির পরদিনই মালয়েশিয়া সরকার বিদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। কয়েক মাস পর বিদেশী কর্মী না নেয়ার ঘোষণা প্রত্যাহার হলে জিটুজি প্লাস চুক্তির আওতায় কর্মী নিয়োগের বিষয়টি আবারও সামনে আসে। সে সময় প্ল্যান্টেশন, এগ্রিকালচার, ম্যানুফ্যাকচারিং, কনস্ট্রাকশনসহ মোট পাঁচটি খাতে বিপুলসংখ্যক কর্মী নেয়ার ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া সরকার। জানা গেছে, অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিদেশী কর্মীদের বৈধ করতে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রি-হায়ারিং প্রকল্প শুরু করে দেশটির সরকার। কর্মীরা যাতে এই সুযোগ নিয়ে বৈধ হতে পারেন, সেজন্য কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানোর পর এ বছরের ৩০ জুন করা হয়েছিল। রি-হায়ারিং পদ্ধতিতে বৈধকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম ধাপ হলো নিজ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশনে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়া। এরপর পর্যায়ক্রমে বাকি ধাপ শেষে পাওয়া যায় বৈধতা। এই বৈধতা পেতে একজন কর্মীকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়। দালাল ও হাইকমিশনে বড় অঙ্কের টাকা দিয়েই বৈধতা পাওয়া যায়। বর্তমানে বহু কর্মী এখন দেশটিতে অবৈধ হয়ে পড়েছেন।
×