ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুন্সীগঞ্জ এখন নৌকার ঘাঁটি

সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কোন্দলই ডুবিয়েছে বিএনপিকে

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩ জানুয়ারি ২০১৯

সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কোন্দলই ডুবিয়েছে বিএনপিকে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জ নৌকার জয়জয়কার। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সেই একই দৃশ্য। তাই একদা বিএনপি ঘাঁটিটি এখন বিপর্যয়ে। সঙ্কটে পড়েছে এলাকায় থাকা এখনকার ত্যাগী কর্মীরা। রাজনৈতিকভাবে সাংগঠনিক তৎপরতায় অগোছালো ও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জের ৩টি আসনে বিএনপিকে ডুবিয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিএনপির ভেতর কোন্দল লেগেই ছিল। ওই বিরোধ না মিটিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। প্রার্থিতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনে সেই বিরোধের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে বিএনপির ভরাডুবির নেপথ্যে আরও কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে, প্রচারে অনেকটা পিছিয়ে ছিল দলের নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ এলাকায় পর্যন্ত আসেনি। তাছাড়া দীর্ঘদিন শীর্ষ নেতারা ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের সরকারবিরোধী কোন আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায়নি। তাই মুন্সীগঞ্জ এখন আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে রূপান্তর হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার ৩টি আসনেই ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করে দলটির সংসদ সদস্য প্রার্থীরা। একই চিত্র ছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও এখানকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে যে বড় ধরনের প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তাও পারেনি। মুন্সীগঞ্জের ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে কোন কৌশলই কাজ হচ্ছে না। ধর্মের দোহাই, ভারতবিরোধী প্রচার করে ভোটারদের মাঝে শঙ্কা সৃষ্টিসহ সব মিথ্যাচারই বুঝতে পেরেছে মানুষ। বরং সকলের কাছেই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মূল চেতনা এবং দেশপ্রেম ও উন্নয়নকে বড় করে দেখছে। তাছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় ইমেজ তথা জিয়া পরিবারের ইমেজ তলানিতে পৌঁছেছে। অন্যদিকে বিগত দশকটি উন্নয়নের স্বর্ণদশক হিসেবে সকলের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর শেখ হাসিনার ব্যক্তি ইমেজ বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে তৃণমূলে। শেখ হাসিনা বাঙালী জাতির কাছে এখন প্রাণের মানুষ সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। তাই অনেকেই বিএনপি ছেড়ে যাচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জ-১ (সিরাজদিখান-শ্রীনগর) আসনে মহাজোটের প্রার্থী বিকল্প ধারা বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী নৌকা প্রতীকে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৬শ’ ৮১ ভোট পেয়ে বেসরকারীভাবে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৪৪ হাজার ৮শ’ ৮৮ ভোট। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী শাহ-মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার দেখা যায়নি বলে জানান, জেলার শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মমিন আলী। শ্রীনগর উপজেলার প্রভাবশালী এই বিএনপি নেতা দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের মাঠ না থাকায় সাংগঠনিকভাবে সুগঠিত হতে পারেনি। দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরেই মমিন আলী দলের সংসদ সদস্য প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের মাঠে নামেননি। এতে এখানে বিএনপি দলীয় প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন নির্বাচনের মাঠে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচনী এলাকার সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামেননি। এখানেই নির্বাচনের মাঠে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে দলীয় প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে ছিলেন না বিএনপি নেতা শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ। মুন্সীগঞ্জ-২ (টঙ্গীবাড়ি-শ্রীনগর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি নৌকা প্রতীকে ২ লাখ ১৫ হাজার ৩শ’ ৮৫ ভোট পেয়ে বেসরকারীভাবে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহা ধানের শীষ প্রতীকে পান ১৪ হাজার ৬৫ ভোট। নির্বাচনের মাঠে বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহার সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর রিপন মল্লিক। ২৮ নবেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে দলীয় কোন্দলের জের ধরে টঙ্গীবাড়ি উপজেলা পরিষদ এলাকায় রিপন মল্লিক ও মিজান সিনহার দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রথমদিকে আলী আজগর রিপন মল্লিক হয়ে উঠেন দলীয় প্রার্থীর আরেক প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয় টঙ্গীবাড়ি থানায়। আসামি হন মিজান সিনহাসহ দলের কয়েক শ’ নেতাকর্মী। তাছাড়া গত ২৩ ডিসেম্বর রাত ১টার দিকে ঢাকা থেকে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েসহ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে নির্বাচনী এলাকার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বাহেরপাড়া এলাকায় মিজানুর রহমান সিনহার গাড়িতে হামলা ও ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত মিজান সিনহার দেহরক্ষী বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলায় আলী আজগর রিপন মল্লিককে আসামি করা হয। কাজেই এ আসনে দলীয় কোন্দলের আগুনে দগ্ধ হয় বিএনপি প্রার্থী মিজান সিনহা। আবার বিগত ১০ বছর নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগে ভাটা পড়ে মিজান সিনহার। আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা দলীয় কর্মসূচীতে উপস্থিত না থাকার পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের বিভিন্ন কমিটি গঠন করাকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর বিরোধ লেগেই ছিল। সবকিছু মিলিয়ে মিজান সিনহা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ার কারণেই নির্বাচনের ফলাফলে বিপর্যয় নেমে এসেছে। মুন্সীগঞ্জ-৩ (সদর-গজারিয়া) আসনে বিএনপির প্রার্থী আব্দুল হাইকে গত ১০ বছরে তেমন কোন আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায়নি। এতে সাংগঠনিকভাবে দলের নেতাকর্মীরা ছিলেন অগোছালো। নিজের ঘর সদরের পঞ্চসার ইউনিয়নেও সাধারণ ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনের মাঠে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন আব্দুল হাই। ভোট ব্যাংক গজারিয়া উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হয়। আবার অনেক নেতাকর্মীরই দলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অনেক নেতাকর্মী মিশে গেছেন প্রতিপক্ষ রাজনীতির সঙ্গে। এছাড়া এ আসনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন ও তার অনুসারী অনেকে নির্বাচনের মাঠে নামেননি। দলের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে প্রচারে দেখা যায়নি দলটির শীর্ষ নেতা কামরুজ্জামান রতনকে। দলীয় কোন্দলের কারণেই জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের মাঠে নামেননি বলে মনে করছেন অনেকে। এমন নানা কারণেই নির্বাচনের মাঠে অগোছালো ছিল দলের নেতাকর্মীরা। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩শ’ ৫৮ ভোট পেয়ে বেসরকারীভাবে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আব্দুল হাই ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৭শ’ ৩৬ ভোট।
×