ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৩ জানুয়ারি ২০১৯

সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য

ঋতুর বর্ণময় আত্মপ্রকাশের রঙিন মঞ্চে শীত তার বাহারি উৎসবের প্রণোদনা নিয়ে হাজির হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নবান্নের উৎসব শেষে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই সাবলীল থাকে। শ্রম-ঘামের বিনিময়ে কষ্টের ফসল থেকে অর্জিত অর্থ তাদের স্বস্তি এনে দেয়। স্বস্তির অনুভূতি তাদেরকে দেয় উৎফুল্লতা। শীতের মৌসুমে তাদের এমন উৎফুল্লতায় আয়োজিত হয় নানান উৎসব। বর্তমানে তথ্য- প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের আশীর্বাদ পুষ্ট নাগরিক সংস্কৃতির এই যুগে আগের মতো না হলেও গ্রাম-বাংলায় লোক-সংস্কৃতি বিষয়ক উৎসব এখনো অনাবিল আনন্দের উৎস। শীতজুড়ে বিনোদনের নানান অনুষঙ্গ হিসেবে সার্কাস, নৃত্য, পুঁথি-পাঠ, জারিপালা, মাঘীপূর্ণিমা, পুতুলনাচ, মাদার বাঁশের জারি, কবিগান, মুর্শিদিগান, মানিক পীরের গান, মাইজভান্ডারি গান, যাত্রা ও পালা গানের আয়োজন গ্রামীণ জনমনে আনন্দের খোরাক যোগায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে লোক সংস্কৃতির এই উৎসবগুলো শীতের রাতেই আয়োজন করা হয়। শীত এলেই যাত্রা ও পালা গানের শিল্পীরা বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পথে-প্রাণÍরে। এইসব পেশাদার যাত্রার দল পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে শীতকালজুড়ে পরিবেশন করে যাত্রাপালা। অন্যদিকে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা শখের বশে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে নিজেরাই অভিনয় করে যাত্রাপালার আয়োজন করে। এক্ষেত্রে শীতের প্রথম দিকে গ্রামের সাধারণ কৃষক, কামার, কুমোর, ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ নিজেরাই বিভিন্ন চরিত্রে মহড়া দিয়ে একটি সফল যাত্রাপালা প্রস্তুত করে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে গ্রামের লোকজন কনকনে শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাত জেগে যাত্রাপালা দেখতে যায়। অভিনয় দেখে মুগ্ধতা নিয়ে তারা গভীর রাতে বাড়ি ফিরে। এছাড়া শীতের রাতে নানা ধরনের নাট্যগীতের আয়োজনে মুখরিত হয় গ্রাম বাংলা। গ্রামের লোকজন সদ্য ধানকাটা মাঠে বা জনাকীর্ণ এলাকায় বিশাল প্যান্ডেল করে সার্কাস খেলার আয়োজন করে। সার্কাস দেখতে ছুটে যায় নানান বয়সী মানুষ। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জের স্কুল মাঠে বা খেলার মাঠে ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, মোরগ লড়াইসহ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী খেলার আসর শীত মৌসুমেই অনুষ্ঠিত হয়। শীতজুড়ে সুফি ও বাউল ভাব দর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী উৎসবে উদ্ভাসিত হয়। বিভিন্ন মরমী সাধকদের মাজার ও খানকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ওরস ও মেলার আয়োজন। এমন উৎসব মুখর পরিবেশে জাতি ধর্ম বর্ণ ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিনোদনের পাশাপাশি ধর্মচর্চারও সুযোগ পায়। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ একসাথে হয়। একে অপরের সাথে ভাব-বিনিময় করে, খোঁজ-খবর নেয়। শীতজুড়ে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় অনুষ্ঠিত এসব উৎসবের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন সুদৃঢ় হয়। গ্রাম-বাংলায় এমন নানান উৎসব কিংবা স্বপ্নীল সব অনুসঙ্গ নিঃসন্দেহে শীত ঋতুকে পরিপূর্ণতা দান করে। শীতের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের এই সংযোগ বেঁচে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথের উক্তি- প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। একাকী কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে
×