ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় নিমিষে তৈরি হয় মাটির তৈজস

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২ জানুয়ারি ২০১৯

নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় নিমিষে তৈরি হয় মাটির তৈজস

মীর আব্দুল আলীম ॥ কুমারদের জীবনটাই কারুকাজময়। ওদের হাতের ছোঁয়ায় নিমিষেই তৈরি হয়ে যায় সুন্দর সব মাটির জিনিসপত্র। দৃষ্টিনন্দন ফুলদানি, পশু-পাখি, কলস, মাটির তৈজসপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি ওদের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ারই ফসল। এতো কিছুর পরও ওদের জীবনযাত্রা আজ হুমকির মুখে। ফলে ওরা আজ আর টিকে থাকতে পারছে না। হারিয়ে যাচ্ছে ওদের মৃৎশিল্পের চিরায়ত ঐতিহ্য। কুমারদের জীবনে এখন রীতিমতো চলছে ভাঙ্গনের খেলা। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর প্রযুক্তির উন্নয়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে আমাদের মৃৎশিল্পীরা আজ তাদের পেশাগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পী ও তাদের পরিবার পূর্বপুরুষের পেশার মর্যাদাকে ধরে রাখতে অনেক সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বর্তমানে ওদের অবস্থা খুবই নাজুক। নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটছে ওদের দিনকাল। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল এলাকার পালপাড়ার অধিবাসীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে গোলাকান্দাইল পালপাড়া। যার আদি নাম গোয়াল পাড়া। রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের পালপাড়ার বুকের ওপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম এশিয়ান হাইওয়ে। এ সড়কটিই মিশে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে। গাছগাছালির সবুজ ছায়াঘেরা এবং পাখির কলকাকলিতে মাতোয়ারা এই পালপাড়ায় অর্ধশতাধিক পাল পরিবার বসবাস করে। এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের শব্দ, পাখির কলকাকলি এবং পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মরানদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এই পাল পরিবারের কারো মনোযোগ আকর্ষণ করে না। ওরা স্ত্রী-সন্তান পরিবারের সকলে মিলে ব্যস্ত মাটির বাসনপত্র ও খেলনা সামগ্রী তৈরিতে। জিতেন পাল, অজিত পাল, জমসদ পাল, বিষু পাল, ভরত পাল, বলাই পাল এরা সবাই ব্যস্ত কাজে। কীভাবে মাটির পাত্র, খেলনা সামগ্রী তৈরি হয় জিজ্ঞাসা করতেই ভরত পাল বললেন- প্রথমে তারা এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে। এ মাটি আগে ঘরের কাছেই পাওয়া যেত। এখন আর তা সহজে পাওয়া যায় না। অনেক সময় দূরে-বহুদূর থেকে নৌকায় করে সংগ্রহ করে আনতে হয়। মূলত পার্শ্ববর্তী আধুরিয়া থেকে মাটি কিনে আনে এরা। এক ভরা নৌকার মাটির দাম ১২ থেকে ১৪শ’ টাকা। এই মাটি এনে প্রথমে বাড়ির একটি নির্ধারিত স্থানে জমা করে তা পানিতে ভিজিয়ে তৈরি করা হয় মাটির খামারি। সোজাসাপ্টা ভাষায় যাকে বলা হয় কাদামাটি। এই মাটি দিয়ে নিপুণভাবে তৈরি করা হয় পুতুল, আম, জাম, পেঁপে, হরিণ, বাঘ, ঘোড়া ও সিংহসহ নানাজাতের খেলনা সামগ্রী, হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র। এর পর তা রোদে শুকিয়ে দেয়া হয় আগুনের ভাঁটিতে। এই আগুন জ্বালানোর জন্য বিশিষভাবে তৈরি করা হয় ভাঁটি। ভাঁটিতে পুড়িয়ে আবার তা নানা রঙে সাজানো হয়। এরপর তা বাজারে বিক্রি করা হয়। পালপাড়ার নামকরণ ॥ এই এলাকার নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন ইতিহাস জানা যায়নি। তবে এ এলাকার কুমাররা কয়েক পুরুষ ধরে মৃৎশিল্প তৈরি করে আসছে বলে জানালেন সমরেশ পাল। এলাকার সব চেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি শত বসন্ত পার করা নগেন্দ্র পাল জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, এখানে এক সময় মুড়াপাড়ার জমিদারদের গরু- ছাগলের গোয়াল ছিল। সেই থেকেই এলাকাটির নামকরণ হয় গোয়ালপাড়া। সে সময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বেশ কদর ছিল। মুড়াপাড়া পরগনায় কোন পালপাড়া না থাকায় কাশিমপুর থেকে জমিদার রামরতন ব্যানার্জি পালদের একটি সম্প্রদায় এনে গোয়ালপাড়ায় অধিষ্ঠিত করেন। দান করেন থাকার জমি। ক্রমে ক্রমে এখানে গড়ে ওঠে কুমার পরিবার। কুমারদের আধিক্যের কারণে এক সময়কার গোয়ালপাড়া গ্রামটি এখন পালপাড়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন এলাকাটি আর গোয়ালপাড়া হিসেবে চেনে না। এক সময় মৃৎ শিল্প সমৃদ্ধশালী হওয়ার কারণে দিনে দিনে এখানে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কালের বিবর্তনে অনেকেই এখন বাপ-দাদার পেশা ছেড়েছেন। তাদের কেউ চাকরি কিংবা রিক্সা চালান, কেউ দিন মজুর। বর্তমানে এখানে ৫০টির মতো পাল পরিবার রয়েছে। তারা টিকে আছে কোনমতে। তৈরির নিয়ম ও খরচ ॥ রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইলের কুমারপাড়া এলাকায় মৃৎশিল্প তৈরি করার কোন চাকি নেই। পুরুষ ও বউদিদের নিপুণ হাতের কারুকার্যেই তৈরি হয় মৃৎশিল্প। এ এলাকার কুমাররা পার্শ্ববর্তী আধুরিয়া এলাকা থেকে মাটি কিনে আনে। এই মাটি বাড়িতে এনে এতে তুষের সঙ্গে মিশিয়ে কাদা (ছানা) করতে হয়। এরপর মাটির আকৃতি দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি হয়। তবে আজকাল মাটির তৈরি জিনিসের দাম কমে যাওয়ায় খরচ গিয়ে আর আগের মতো লাভ হয় না বললেন অতুর পাল। মাটির সামগ্রীর দাম ॥ কদর না থাকায় কম দামেই মাটির সামগ্রী বিক্রি করছে এ এলাকার কুমাররা। এখানে হাঁড়িপাতিল পাওয়া যায় সাইজ ভেদে ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। ফুলের টব পাওয়া যায় ৫ থেকে ১০ টাকার মধ্যে। ফুলদানি ৫-৭ টাকা, বড় বড় হাতি, ঘোড়া, পুতুল, টেবিল ল্যাম্প, মাটির গাছ পাওয়া যায় ৫০ থেকে ১শ’ টাকার মধ্যে। এক সঙ্গে বেশি কিনলে আরও সস্তায় পাইকারি দামে কেনা যায়। এক কথায় ঢাকার তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে কেনা যায় যেকোন মাটিরসামগ্রী। কোথায় যায় এগুলো ॥ এখানকার তৈরি মাটিরসামগ্রী ঢাকার ধানম-ি, শিশু একাডেমি, শাহবাগ ও রাজাবাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ও মেলায় যায়। গোলাকান্দাইলের কুমারদের তৈরি সামগ্রী সুক্ষ্ম কারুকার্য খচিত ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় ঢাকার ক্রেতাদের কাছে এসবের চাহিদা প্রচুর। বর্তমানে কিছু এনজিও এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহে পরিকল্পিতভাবে মাটির বিভিন ধরনের জিনিস তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের রং, বার্নিশ, কারুকাজ ব্যবহার করে মাটির তৈজসপত্রগুলোকে করা হচ্ছে আকর্ষণীয়। এগুলো বিদেশে রফতানিও হচ্ছে সীমিত আকারে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অভিজাত বিপণী বিতানগুলোতে বিক্রিও হচ্ছে ব্যাপক হারে। কিন্তু এর সঙ্গে কুমারদের সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। এরা চলে যাচ্ছে বিভিন্ন পেশায় ॥ মৃৎশিল্পের ব্যবসা আগের মতো না থাকায় কুমাররা তাদের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। যারা পেশা ছেড়ে দিয়েছে তাদের অনেকেই ভূমিহীন কৃষক। পরের জমি বর্গা করে চলে তাদের সংসার। দারিদ্র্য যাদের গায়ে মাখা, স্মৃতি কি তাদের মানায় দাদা বলেন? এ রকম প্রশ্ন রেখেই বিপুল পাল বলেন, দাদা আমাগো কষ্টই শেষ হয় না। কেমনে আবার বাপ- দাদার স্মৃতি ধইরা রাখুম। আগে বানাইতাম, এহন পেটের তাড়নায় ৭শ’ টাকা মাইনে তাঁতের কাম করি। কি করমু বাঁইচ্যা থাহনতো লাগবো। কুমারদের সুখ-দুঃখ ॥ পাকিস্তান আমলের বিশিষ্ট ২২ পরিবারের অন্যতম ভুঁইয়া পরিবার। সেই পরিবারের অন্যতম গুলবক্স ভুঁইয়ার ছেলে মজিবর ভুঁইয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয় কুমারপাড়া ঘেঁষেই অবস্থিত। তারপরও কুমার পরিবারগুলোতে শিক্ষার তেমন আলো নেই। কারণ হিসেবে তারা জানালেন, তাদের পাড়ার মনো পাল বিএ পাস করে কোন চাকরি পায়নি। এখন পার্শ¦বর্তী এলাকায় টিউশনি করে সংসার চালায়। শিক্ষার পরিবেশও নেই এ এলাকায়। কুসংস্কার ও অনগ্রসরতা এ এলাকার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সরেজমিন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলাকার মানুষগুলো কেমন ভাবুক। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কি হলো না হলো তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা নেই রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়েও। গৌরাঙ্গ পাল বলেন, দাদা রাজনীতি ফাজনীতি বুঝি না, ভোট আইলে মন চাইলে ভোট দেই। ঐ ব্যাটারা ভোট আইলে আমাগো খবর লয়, পরে আর খবর থাকে না। বিপর্যয়ের নানা কারণ ॥ এ্যালুমনিয়াম, মেলামাইন, স্টিল, সিরামিক প্রভৃতি আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে কুমারদের। কিন্তু এসব শিল্পের মতো তাদের নেই কোন উন্নত যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন, মাটি, লাকড়ি, রং- এসবের উচ্চ মূল্যের কারণে তারা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। এক হাজার টাকার মাটি কিনলে তার সঙ্গে ২ হাজার টাকার লাকড়ি লাগে। এরপর প্রতিদিন তিনজন করে লোক খাটলে এক মাসে তৈরি করা যায় ৯ হাজার টাকার সামগ্রী। পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় লাভ তেমন একটা থাকে না। তাই দিন দিন এ শিল্পের প্রতি কুমারদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। আগে কাঠের চাকা ঘুরিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন মাটির সামগ্রী। তাতে পরিশ্রম হতো অনেক। এখন মেশিনে তৈরি করা হয় এসব জিনিস। তাও আবার সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। একটি মেশিনের মূল্য ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা ॥ আজকাল অধিকাংশ শিল্পের জন্য রয়েছে সরকারী-বেসরকারী ঋণ ও পৃষ্ঠপোষকতা। এ শিল্পটি সবচেয়ে অবহেলিত। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক উন্নতমানের মাটির সামগ্রী তৈরি করতে পারবে, যা দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন গোলাকান্দাইলের কুমার গোষ্ঠী।
×