ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একদা বিএনপি নামে একটি দল ছিল!

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২ জানুয়ারি ২০১৯

একদা বিএনপি নামে একটি দল ছিল!

হাসান নাসির ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় জয়ের পর আওয়ামী লীগ শিবিরে উচ্ছ্বাস। বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত বলয়ে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। ভোটে বিএনপি হারতেই পারে। কিন্তু এমন লজ্জাজনক হারা হারবে, তা কি তাদের কল্পনাতেও ছিল? ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপির প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। স্বীকার করে নিতে হবে ইতিহাসের সত্যতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে নিজের চেহারাটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। এখনও যদি উপলব্ধি না হয়, তবে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পথে বিএনপি। ভবিষ্যত প্রজন্ম ইতিহাস বইয়ে পড়বে, ‘একদা বিএনপি নামের একটি দল ছিল।’ নির্বাচনে বিএনপির এহেন ভরাডুবিতে চলছে নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় কিছুটা প্রতিকূলতা ছিল, এটা মেনে নিলেও ফল যে এতটা খারাপ হতে পারে তা কল্পনাও করা যায়নি। রাজনৈতিক বোদ্ধামহল মনে করছে, বিএনপির ভোটের অঙ্কেই ছিল বড় ধরনের গলদ। দলটি শেষ পর্যন্তও আঁকড়ে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াতে ইসলামীকে। সর্বশেষ নির্বাচনে জামায়াতের পাওয়া ৩/৪ শতাংশ ভোটের হিসাব নিয়েই বসেছিল বিএনপি। কিন্তু এই ১০ বছরে যে বার্ধক্যজনিত মৃত্যুসহ নানা কারণে জামায়াতের ভোট কমে যাওয়ার পাশাপাশি আড়াই কোটি তরুণ ভোটার যুক্ত হয়েছে, সেই হিসাব মোটেও করেনি দলটি। তরুণ প্রজন্মের কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি অহংকার। এ নিয়ে তরুণদের অনেক কবিতা ও গল্প তো আমরা বিভিন্ন মাধ্যমেই প্রতিনিয়ত দেখছি। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের কথা বলে দেশবিরোধীকে রেখেছে তারই পাশে। অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটি প্রশ্নÑ ‘আপনি যদি যুদ্ধাপরাধীর বিচারই করবেন, তাহলে আপনার পাশেই যুদ্ধাপরাধীরা দাঁড়িয়ে কেন?’ মুখে স্বাধীনতার চেতনার কথা, পাশে কেন স্বাধীনতাবিরোধীরা? স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার হার এবং তরুণ ভোটার যতই বাড়ছে, ততই স্বাধীনতাবিরোধীরা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছেÑ এই হিসাবটা বিএনপি করেনি। বিএনপির শিক্ষিত সমর্থকরা মনে করছেন, ঘুরে দাঁড়াতে হলে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হতে হবে দলকে। জামায়াতের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতায় তিরোহিত হয়েছে দলের ভাবমূর্তি। ভুল মেনে নিয়ে এখন শুরু করা প্রয়োজন ভোটের নতুন অঙ্ক। বিএনপিতেও মুক্তিযোদ্ধা আছেন, ঠিক যেমনটি বিএনপির এক নেতা বলেছেন জামায়াতে ইসলামীতেও মুক্তিযোদ্ধা থাকার কথা। বাস্তবতা হলো, মুক্তিযুদ্ধের কথা বারবার বলে চললেও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধকে ওন করে না। বিষয়টি দলটির স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে মাখামাখিতেই প্রমাণিত। যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য ছিল, আমরাও বিচার চাই। অথচ এরপরের বাক্যটি শুরু হয় সেই ‘তবে-কিন্তু’ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে এদেশের মানুষ কোন ধরনের ‘তবেÑকিন্তু’ শুনতে চায় না। বরং ভবিষ্যতে এদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নিয়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন বেশকিছু ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য। মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, যুদ্ধাপরাধÑ এসব প্রশ্নে কোন ধরনের অস্বচ্ছ অবস্থান বা গোলমেলে বক্তব্য দিয়ে চলবে না। বরং মৌলিক ইস্যুগুলো মেনে নেওয়াই হবে প্রজ্ঞার পরিচায়ক। বিএনপি যেদিন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে ফেলবে সেদিনই আওয়ামী লীগের রাজনীতি কিছুটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। বিএনপি কার্যালয় থেকে যেদিন বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বেজে উঠবে সেদিন থেকেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাবে আওয়ামী লীগ। বিষয়টি এর মধ্যেই খানিকটা প্রমাণিত হয়েছে। যেমন বিএনপির সঙ্গে থেকেই যখন ড. কামাল হোসেন কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম জপতে থাকলেন, তখন তা আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। চরম বিরোধী চলে যাওয়ার পরও কিন্তু আওয়ামী লীগ ড. কামালের বিরুদ্ধে কিংবা মুজিব কোটধারী সিলেটের সুলতান মনসুরের বিরুদ্ধে সেভাবে কামান দাগতে পারেনি। বিএনপি শত চেষ্টা করেও মহান মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব তাদের ঘরে তুলতে পারবে না, তা তাদের বুঝতে হবে। সুতরাং নিজেরা ইতিহাস লেখার চেষ্টা না করে রচিত ইতিহাস মেনে নেয়াই রাজনৈতিক সততা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যত লম্বা আলোচনায় হোক না কেন, আমজনতার কাছে এই ইতিহাস মাত্র ৭ লাইনের। আর তা হলো এক. বাংলাদেশ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশ। দুই. বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিন. আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। চার. অধিকাংশ বামপন্থী দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পাঁচ. অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। ছয়. ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া ছিল সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। সাত. আমেরিকা ও চীন ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তির সংগ্রাম বিষয়ে সাধারণ মানুষের ইতিহাসজ্ঞান এটুকুই যথেষ্ট। এটুকু জানবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের প্রয়োজন নেই। এই সাতটি লাইনের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত আলোচনা, তার সবই ইন্টেলেকচ্যুয়াল ডিবেট। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ধারণ করতে না পারায় আওয়ামী লীগ একান্ত নিজের সম্পদ করে নিতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশেই রাষ্ট্রের স্থপতিকে নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু এতে দলগুলোর রাজনীতি করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। বিএনপি শত চেষ্টা করেও তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। কারণ জিয়া মুক্তির সংগ্রামের নেতা ছিলেন না। কোন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা তিনিই দেবেন, যিনি ওই সংগ্রামের প্রধান নেতা। প্রধান নেতাকে ডিঙ্গিয়ে অন্য কেউ ঘোষণা দিলেও তা ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত হবে না। বস্তুতপক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার কোন এখতিয়ারই ছিল না। কেননা তিনি নেতা নন। তার নেতৃত্বে মুক্তির সংগ্রাম পরিচালিত হয়নি। বিএনপি বড়জোর জিয়াউর রহমানকে ২৭ মার্চ বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার অন্যতম ঘোষক দাবি করতে পারে, যা সেই বেতার ঘোষণার মধ্যেই পরিষ্কার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রজন্ম ২১ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস পড়েছে। এখনকার প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস জানছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠের ভাষণ তো প্রমাণ হিসেবে রয়েই গেছে। ইতিহাস হওয়ার পথে বিএনপি। এদেশের রাজনীতিতে বিএনপির টিকে থাকতে হলে অবশ্যই বদলে যেতে হবে। অর্ধসত্য দিয়ে পার পাওয়া যায় না। বরং অর্ধসত্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা থাকা চাই। দলটি যদি এই সত্যটা উপলব্ধি কিংবা মেনে নিতে না পারে, তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম পড়বে, একদা বাংলাদেশে বিএনপি নামের একটি রাজনৈতিক দল ছিল, যে দলটি রাষ্ট্রক্ষমতাও করায়াত্ত করেছিল। কিন্তু এতবড় একটি মুক্তিযুদ্ধ বিস্মৃত হয়ে দেশবিরোধী ভূমিকায় চলে যাওয়ায় বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে।
×