ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চুপসে গেছে বিএনপি, আপাতত আন্দোলন নয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২ জানুয়ারি ২০১৯

চুপসে গেছে বিএনপি, আপাতত আন্দোলন নয়

শরীফুল ইসলাম ॥ নির্বাচনের পর আন্দোলন কর্মসূচী দেয়ার হুমকি দিলেও এখন চুপসে গেছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম হতাশ। তারা এভাবে শোচনীয় পরাজয়ের জন্য কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের দায়ী করছেন। কোন অবস্থাতেই তারা আন্দোলনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সায় দিচ্ছেন না। আর এ কারণেই আপাতত বিএনপি কোন আন্দোলন কর্মসূচী দিচ্ছে না। তবে ঐক্যফ্রন্ট ঘোষিত নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপিসহ স্বাভাবিক কিছু কর্মসূচী পালনের চেষ্টা করবে। সূত্র মতে, ৩০ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচীর বিষয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু কোন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারাই আপাতত আন্দোলন কর্মসূচী পালনে সায় দেননি। তাদের যুক্তি এমনিতেই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত হয়ে তারা নানামুখী হয়রানির শিকার, নির্বাচনে সেখানে দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করলে আরও বেশি নাজেহাল হতে হবে। তার চেয়ে আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীরা নিজ নিজ পেশাগত কাজে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর সেক্ষেত্রে সরকারী দলের লোকেরাও আর হয়রানি করার চেষ্টা করবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের এক নেতা বলেন, কেন্দ্রের ভুলের কারণে বার বার দলকে মাসুল দিতে হচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে কেন্দ্র থেকে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে সিনিয়র নেতারা ঢাকায় বাসায় অবস্থান করেন। আর তৃণমূল নেতাকর্মীরা রাজপথে কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে মামলা-হামলার শিকার হন। এ ছাড়া এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কেন্দ্র থেকে বাস্তবসম্মত কৌশল গ্রহণ করা হয়নি। তাই আওয়ামী লীগের বাস্তবসম্মত বিভিন্ন কৌশলের কাছে বিএনপি মার খেয়েছে। তাই এ পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিলে তা সফল হবে না। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। এক পর্যায়ে এ অবস্থান থেকে সরে এসে বলে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা। জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচনকালীন একটি সরকারের খসড়া রূপরেখাও তৈরি করে বিএনপি। কিন্তু এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেয়নি দলটি। খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিতে চাইলে খালেদা জিয়া নিজেই আন্দোলন থেকে বিরত থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করতে দলের নেতাদের নির্দেশ দেন। এর ফলে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশন কর্মসূচী ছাড়া আর কোন কর্মসূচী পালন করেনি। নির্বাচন কাছাকাছি চলে এলে আন্দোলন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বাদ দিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এক পর্যায়ে বিএনপি মহাসচিব বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কাছে ধর্না দেন। এই দুই প্রবীণ নেতাই বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর নির্বাচনী জোট করতে সম্মত হন। তবে তারা শর্ত দেন বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আসতে হবে। বৃহত্তর জোটে আসম রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও আনার চেষ্টা করে বিএনপি। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অধ্যাপক ডাঃ বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধী বিকল্প ধারা বৃহত্তর জোট গঠন থেকে সরে যান। কিন্তু জামায়াত বিএনপির সঙ্গে থাকলেও তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করতে সম্মত হয়ে যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ১৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ৭ দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্য তুলে ধরেন। জোট গঠনের সময় বলা হয়েছিল খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ৭ দফা দাবি না মানলে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যজোট আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী পালন করে দাবি আদায় করবে। এ বার্তা পেয়ে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপিসহ এ জোটের অন্যান্য শরিক দলের নেতারাও সংলাপে অংশ নেন। প্রথম দফায় ১ নবেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় ৭ নবেম্বর সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপের পর বিএনপি দাবি আদায়ে আন্দোলনের কথা বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই পুরোদমে নির্বাচনমুখী হয়। কিন্তু কেন্দ্রের এ কৌশল তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ৮ নবেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো উৎসবমুখর পরিবেশে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়। এর ফলে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। ১২ থেকে ১৬ নবেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যক ৪ হাজার ৫৮০ জন বিএনপি নেতা দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি। আওয়ামী লীগ থেকে এবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন ৪ হাজার ২৩ জন। ১৮ নবেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২১ নবেম্বর পর্যন্ত লন্ডনে বসে স্কাইপিতে ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করা দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে তিনি স্কাইপিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দেন। তবে দ- নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান স্কাইপির মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নিয়ে বেআইনী কাজ করেছে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ২০৬ জন এবং ৮ ডিসেম্বর বাকি আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। এর মধ্যে জামায়াতকে ২২টিসহ জোটের শরিকদের ৬০টি আসন ছেড়ে দেয়। তবে জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়ে দলটি। খোদ বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও হাইকমান্ডের এ সিদ্ধান্ত মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। এ ছাড়া যেসব আসনগুলো জামায়াতকে ছাড়া হয় সেসব এলাকার তৃণমূল নেতারা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ভর করে। এ কারণে তারা ভোটের মাঠেও নিষ্ক্রিয় ছিল। এবার দলীয় হাইকমান্ডের মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে বিএনপির অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা দল থেকে মনোনয়ন পাননি। কেন তাদের মনোনয়ন দেয়া হয়নি কারণ জানতে তারা ছুটে যান বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় ও নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এর মধ্যে বেশ ক’জন মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা তাদের অনুসারীদের নিয়ে বিএনপির দুই কার্যালয়ের সামনে সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ পরিস্থিতিতে কয়েকটি আসনে প্রার্থী রদবদল করা হয়। তারপরও যোগ্য যারা মনোনয়ন পায়নি তারা নীরবে নিজেদের দলীয় কর্মকা- থেকে সরিয়ে নেন এবং এলাকায় গিয়ে গোপনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেন। চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার পর বিএনপির প্রার্থীরা যখন নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত তখনও মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে কোথাও কোথাও প্রার্থী বদল করা হয়। সিলেট সদর আসনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মনোনয়ন পেয়ে তিনি জোরেশোরে প্রচারেও নামেন। কিন্তু হঠাৎ করে কোন কারণ না দেখিয়ে তাকে বাদ দিয়ে খন্দকার মুক্তাদীর চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিবাদে ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরীসহ আরও ক’জন নেতা দল ত্যাগ করেন। ইনাম আহমেদের মতো যোগ্য নেতার বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাওয়া নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এ বিষয়টিকে ভালভাবে নিতে পারেননি। নির্বাচনের শেষের দিকে বিএনপির বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা মাঠে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাই সরকারী দল আওয়ামী লীগ প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় বড় বড় শোডাউন করলেও বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় দায়সারা প্রচার চালায় দলটি। ভোটের দিন কেন্দ্রেও বিএনপি নেতাকর্মীদের তৎপরতা চোখে পড়েনি। আর এ কারণেই নির্বাচনী ফলাফলে দলটির ভরাডুবি হয়। এ পরিস্থিতিতে সারাদেশে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। তাই তারা এখন কোন অবস্থাতেই আন্দোলনে শরিক হতে রাজি হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে। তবে কবে দেয়া হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কর্মসূচী ঠিক করা হবে। যখন কর্মসূচী ঠিক হবে তখন সবাই জানতে পারবে।
×