ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

নির্বাচন ২০১৮ ॥ ডাক দিয়ে যাই

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২ জানুয়ারি ২০১৯

নির্বাচন ২০১৮ ॥ ডাক দিয়ে যাই

৩০ ডিসেম্বর ১৬ পৌষ ভূমিধস নির্বাচন বিজয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জনবন্ধু শেখ হাসিনা। চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ, তবে অত্যন্ত কঠিন যাত্রাপথে তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানাই। শেখ হাসিনার শাসনকালে সবগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালে ষষ্ঠ, ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল যথাক্রমে শতকরা ৩৪, ৩৭, ৪১ ও ৪৮ শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই পরিসংখ্যানিক প্রবণতায় শতকরা ৬০ শতাংশ ভোট পাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তবে অন্যান্যবারের মতো এবার আমার নিজের হিসাব-নিকাশ ঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগ ১৮০-১৯০টি আসন আর বিএনপি ৯০-৯৫টি আসন পাবে বলে অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল। বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ বিএনপির ভোট বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ক. প্রায় দশ বছরের জনবিচ্ছিন্নতা, খ. ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে প্রতিহত করার নামে মানুষ পোড়ানো ও সম্পত্তি নষ্ট করা, গ. অবরোধ নাটক করা, ঘ. শেখ হাসিনার অনন্য সাহসী ৫০-৫০ ফর্মূলার মন্ত্রিসভার কাঠামো প্রত্যাখ্যান করা, ঙ. স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহী অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে মানবতা হত্যার অপরাধীদের সঙ্গে যতিবিহীন গাটবন্ধনে থাকা, চ. পাকিস্তান তথা আইএসআই-এর সঙ্গে প্রকাশ্য দহরম-মহরম করা, ছ. পরিবারতন্ত্রে নেতৃত্বের সঙ্কট, জ. কার্যত কোন উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা না করাকে কারণ বলে মনে করা হয়। সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত সবল নেতৃত্ব, নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান এবং প্রায় দু’বছর ধরে সঠিকপথে নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ আওয়ামী লীগের বিজয় অর্থাৎ ২৫৯টি আসনে জয়ী হতে সহায়তা করেছে বৈকি। এ নির্বাচনের অন্যতম বিশাল সফলতা: দেশদ্রোহী, জঙ্গী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতীরা কোন আসনেই জয়লাভ করেনি। শেখ হাসিনার অনন্য বিজয়গাথা অকুতোভয়, চৌকস, দক্ষ, গতিময়, উদ্ভাবনী, জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল এবং মানুষকে কাছে টানা ও ভালবাসার মোহনীয় ক্ষমতা শেখ হাসিনাকে এক জাদুকরী নেতৃত্বের উচ্চ আসনে নিয়ে গেছে। দেড় বছর পর তিনি ইন্দিরা গান্ধী, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, মার্গারেট থ্যাচার, ভিগদিস ভিনগোদি ও মেরি মেকলিসকে টপকিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়ের সফল সরকারপ্রধান হিসেবে বিরাজমান হবেন। বিশ^সভা তার নেতৃত্বকে মর্যাদা দেয়। তিনি মাদার অব দ্য আর্থ। শেখ হাসিনা মানবতার মাতা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে অনন্য কৃতিত্বের সঙ্গে। বোদ্ধারা বলছেন আগামী ১২/১৪ বছরে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে উঠবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষা : নারীর ক্ষমতায়নে লিঙ্গসমতা সূচকে চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ^সেরা আর সামগ্রিক সূচকে ১৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৮তম স্থানে- দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক ওপরে। ১৯৭২ সালে হিউস্ট ফ্যালান্ড আর জ্যার্ক পারকিনসন ‘বাসকেট কেস’ বলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে সন্দিহান হয়ে যে কটাক্ষ করেছিলেন বিশে^র তাবত অর্থনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠান ও দেশসমূহ শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তিনটি সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি বলে স্বীকৃতি দিয়ে তার জোরদার খ-ন করেছে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়নসূচক এইচডিআইতে বাংলাদেশ এখন মধ্যম পর্যায়ে- ৭২ বছরের গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৩০-এর নিচে আসা, শিক্ষায় উচ্চহার, সুপেয় পানি ও বিজ্ঞানসম্মত পয়ঃনিষ্কাশনে অগ্রগতি এবং চমকপ্রদ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের কাঠামোতে নাকি এ ক্ষেত্রে শক্তি জুগিয়েছে। শেখ হাসিনা মানুষকে ভালবাসেন। শিশুদের আরও বেশি এবং শারীরিকভাবে হুমকির সম্মুখীনগণকে সবচেয়ে বেশি মমতায় তিনি আপন করতে পারেন বলেই আপামর জনসাধারণ তার মনোনীত প্রার্থীগণের ভোট বাক্স ভরে দিয়েছেন। আত্মপ্রসাদ নয়, বরং ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিতকরণ জরুরী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সতর্কবাণী না শুনে কতিপয় অতি উৎসাহী নির্বাচন কমিশনের কিছুটা হলেও গাফিলতির ছিদ্র দিয়ে ৩০/৩৫টি সংসদীয় আসনে শতকরা ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগ ভোটার উপস্থিত করে আওয়ামী লীগ বিজয়ীগণের শতকরা ৯০ ভাগ ভোট প্রাপ্তি ঘটিয়েছেন। এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে পারে। সার্বিক ফলাফলে এর কোন প্রভাব নেই তা মানতেই হবে। বলা বাহুল্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা বাংলাদেশের অতীত অবস্থান ও সমসাময়িক বিশে^র উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম বৈ বেশি নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তা-ব এবং ২০১৪ সালে প্রতিহত করার উন্মাদনার কথা কে না স্মরণ করে! আগামী পাঁচ বছরের করণীয় বড় বিজয়, মজবুত নেতৃত্ব। যেখানে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সেখানেই উন্নয়ন ধারনা জনগণকে এ বিজয় কেতন উড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংস্কার করতে হবে। কোন সংস্কারই সহজ না। সেজন্যই আগত সরকারের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সব না হলেও মুখ্য সংস্কারগুলোতে হাত দিতে হবে। জনমনে প্রত্যাশা হাসিনা সরকার বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি মডেল বদল করে ব্যাপক শিল্পায়ন ও বহুমুখিতা আনা সমীচীন হবে। শিল্পায়নে কর্মসংস্থান হবে, বাড়বে আয়-রোজগার, কমবে দারিদ্র্য ও বঞ্চনা এবং হ্রাস পাবে আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য। এটি করতে হলে অবকাঠামোগত অব্যাহত প্রবৃদ্ধি ঘটাতে হবে, প্রয়োজন হবে অধিকতর বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। সরকারী খাতে দুর্নীতি হ্রাস ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে সরকারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে উদ্বৃত্ত তহবিল সঞ্চয় জরুরী। বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্থিতাবস্থা দূর করতে হলে একদিকে যেমন আকর্ষণীয় পলিসি সংস্কার করে প্রণোদনা দিতে হবে, অন্যদিকে তেমনি করহার না বাড়িয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। উপযুক্ত নীতি কৌশলে মুদ্রাপাচার বন্ধ করা ও রফতানিতে জোয়ার আনতে অর্থনীতি ক্ষেত্রে তথা ব্যাংকিং, বীমা ও মূলধন মার্কেটে বহু বিলম্বিত সংস্কার আনয়ন করে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সততার পথ চালু করতে হবে। সুশাসনে নৈতিকতা, আইন প্রয়োগে কৃতসংকল্পতা এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী তারুণ্যের শক্তিকে বিকশিত করার জন্য ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে অবস্থানকারী তরুণ, তরুণী, যুবক ও যুব মহিলাকে বৃত্তিমূলক এবং প্রযুক্তি শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মতোই উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভর্তি অনুপাত বর্তমানের ৪৩ঃ৫৭ থেকে ৫০ঃ৫০-তে রূপান্তর করা প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতি বছর সামষ্টিক আয়ের ০.৫ হারে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ২০২৩ সালে শিক্ষাক্ষেত্রের বরাদ্দ জিডিপির শতকরা ০৫ ভাগে উন্নীত করা সমীচীন হবে। অনুরূপভাবে স্বাস্থ্যখাতের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনাও প্রয়োজন। একটি নতুন ড্রাগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন বিভাগ, স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরও সমৃদ্ধ করবে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় লিজিংসহ নতুন চিন্তাধারা আনতে হবে। ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী দুর্নীতি দমনে আরও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন। সুশাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতায় কিছুটা বৃদ্ধি, ন্যায়পাল নিয়োগ ও সংবিধানের ৭০ ধারার প্রয়োগে সীমারেখা আনা যায় কিনা তাও দেখা যেতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন গবর্নমেন্ট এবং বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা যায়। রেলপথ ও জলপথের গতিময় উন্নতি প্রয়োজন। বস্ত্রশিল্প, পর্যটন, মৎস্য, দুগ্ধ, আসবাব, চামড়া, ওষুধ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, মটরযান সংযোজন, সিরামিকস ইত্যাদি শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে আগামী পাঁচ বছরে তৈরি পোশাক ও নিট আয়ের সমকক্ষ বিকল্প শিল্পখাত সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া যেতে পারে। পরিশেষে জাতির পিতার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে কল্যাণ রাষ্ট্রে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, দুর্নীতি ও বঞ্চনামুক্ত সমতাপ্রবণ সোনার বাংলাদেশ গঠনে সর্ববলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার পথ খুলে দিয়েছে একদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারত এবং অর্থনীতির পরাশক্তি চীনসহ আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনের বিজয়ে সাধুবাদ জানানোর লহরী সৃষ্টি করেছে ইতোমধ্যে। শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্ব দৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশকে জনকল্যাণের একটি আদর্শ গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে- সে আশা অবশ্যই করা যাবে। লেখক : সাবেক গবর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
×