ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গণজাগরণ

ঐক্যফ্রন্টে আস্থা নেই ভোটারদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১ জানুয়ারি ২০১৯

ঐক্যফ্রন্টে আস্থা নেই ভোটারদের

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমের ভাষায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বিপ্লব হয়েছে বাংলাদেশে। যার মধ্য দিয়ে মহাজোটের ‘মহাজয়’ নিশ্চিত হলো। ভোটের পর দেশজুড়ে সবার প্রশ্ন একটাই তা হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা ২০ দলীয় জোটের ফল বিপর্যয় নিয়ে। কেন বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ভোটাররা এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশিষ্টজনরা বলছেন, বিএনপির প্রতি ভোটারদের আর আস্থা নেই। ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দিয়ে বাংলাদেশে আবারও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের উত্থান কেউ চায় না। বারবার দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ বিশে^ চ্যাম্পিয়ন অর্জন করবে তা মানতে নারাজ নতুন প্রজন্মের ভোটাররা। সবার প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরাপদ বাংলাদেশ ও চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা। যার মধ্য দিয়ে পূরণ হবে আগামীর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। তাই এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভোটাররা। সর্বোপরি সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জাগরণ সৃষ্টি মহাজোটের ফল প্লাবনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন অনেকেই। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে শেখ হাসিনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আস্থা ও বিশ^াস। এছাড়াও বিএনপির দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি, নেতৃত্বের ধোঁয়াশা, অস্পষ্ট বক্তব্য, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইস্যুতে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি, নির্বাচনে প্রচারে না থাকা, বিজয়ের ব্যাপারে অতি মাত্রায় আশাবাদী থাকা, খালেদা জিয়ার জেলসহ বিভিন্ন কারণে ফল বিপর্যয় হয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিএনপির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতার বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য না থাকা। যদিও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, বিপর্যয় নয়; নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়ায় ফল এমন হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলের নেতারা বলছেন, দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। তারা চায় না বাংলাদেশ পরিচালনায় আবারও বিএনপি-জামায়াত জোট দায়িত্ব পালন করুক। পাশাপাশি ‘তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট হোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’ এরকম স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগের হয়ে সারাদেশে কাজ করেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ দেশের বিভিন্ন সেক্টরের আলোকিত মানুষ। যা বিএনপির প্রচারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি। রবিবার অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফলে নৌকার এই অভাবনীয় জয়ের বিপরীতে ভরাডুবি হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে আসা বিএনপির। ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৫৯টি আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে সব সময়ের অতি মাত্রায় আত্মবিশ^াসী বিএনপি পেয়েছে মাত্র ৬টি আসন। দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২০ আসন। অথচ বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের কাতারে বিএনপি প্রতি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে কর্মী-সমর্থক। এরপরও ভয়াবহ ফল বিপর্যয়ের কারণে দলের নেতাদের ভাবিয়ে তুলছে। তাই করণীয় ঠিক করতে সোমবার বিকেল থেকেই বৈঠক করেছেন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। ফল বিপর্যয় প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটা তো নির্বাচন হয়নি। এটা একটা প্রহসন। নির্বাচনের নামে একটা তামাশা হয়েছে। তিনি বলেন, কিভাবে শক্তি ব্যবহার করতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে, তার এক নতুন নমুনা দেখলাম আমরা। আমরা কখনই এরকম নির্বাচন অতীতে দেখিনি। যেখানে পুলিশ, র‌্যাব, প্রশাসন- সবাই মিলে নির্বাচন করছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তো গৌণ। মূল কাজ করছে পুলিশ আর র‌্যাব। তিনি বলেন, এই নির্বাচনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপারটা হচ্ছে এখানে একটি ইনস্টিটিউশন হিসেবে নির্বাচন জিনিসটাকেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। একদম ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষের আস্থা পুরোপুরি চলে গেল বলেও মন্তব্য করেন ঐক্যফ্রন্টের এই মুখপাত্র। তবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম ভোটে বিএনপির কারচুপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি এটা দৃঢ়ভাবেই অস্বীকার করব। কারণ প্রশাসনের কোন ভূমিকা ছিল না এখানে। পুলিশ যে এরকম করেছে, আমাদের কাছে তার কোন রিপোর্ট আসেনি। তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন তারা ভোট বর্জন করতে পারে আমরা তো এটা আগে থেকেই আশঙ্কা করছিলাম। আভাস পাচ্ছিলাম যে বিএনপি এরকম নিশ্চিত পরাজয় জেনে, আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে মাঝপথেই হয়তো হঠাৎ করে নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যাবেন বা অন্য কোন রকম ঘোষণা দেবেন। সোমবার দুপুরে ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকায় আস্থা রাখার মধ্য দিয়ে জনগণ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষদাঁত চিরতরে ভেঙ্গে দিয়েছে। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব, ঐতিহাসিক বিজয়ে সারাদেশ আনন্দে ভাসছে। আমাদের এই বিজয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, বিগত ১০ বছরের উন্নয়ন অর্জন, শেখ হাসিনার উন্নয়নের অগ্রযাত্রার আগামীর যে পথ তিনি দেখিয়েছেন, তারই ফল। তিনি বলেন, দেশের মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে, এই নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয়ের মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। সকল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ম্লান করে দিয়ে এ বিজয় এনে দিয়েছে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাঙালীয়ানা-মুক্তিযুদ্ধ-দেশবিরোধী অপশক্তির অভিশাপমুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ দেশ গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের প্রতি ঐতিহাসিক গণরায়ে দেশবাসীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। তারা বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নতুন সরকার গঠিত হবে সে সরকার আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি দুর্নীতি ও বৈষম্যের অবসান আর আইনের শাসন-সুশাসন নিশ্চিত করতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিবে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে সকল প্রতিকূলতার মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচনের জন্য দেশবাসী জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি মনে করে মহাজোটের এই ভূমিধস বিজয় জনগণের বিজয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয়। ওয়ার্কার্স পার্টি আরও মনে করে, এই আস্থা জনগণের প্রতি দেশের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হওয়ার ম্যান্ডেড। জনগণের উন্নয়নের জবাবদিহিতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শান্তির প্রত্যাশাকে বিজয়ী করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। ফল বিপর্যয় হয়নি দাবি করে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, মানুষ আমাদের ভালবাসে একথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। নীল নক্সার নির্বাচনে করা হয়েছে। এ রকম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা কোন নির্বাচন হয়নি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা থাকলেও সরকার তা করেনি। মানুষকে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি বলেই ফল এমন হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়ে দেশজুড়ে মাঠ চষে বেরিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তাদের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনের আহ্বায়ক তিনি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ’৭০-এর পর এবারের নির্বাচনের মতো ভোট বিপ্লব আর হয়নি। তিনি বলেন, মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চরিত্র হলো তিনি ‘অসামান্য নেত্রী’। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বের ধোঁয়াশা ছিল সব সময়। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের একটি দর্শন, চেতনা, অতীত ও চরিত্র আছে। যা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। জামায়াত-যুদ্ধাপরাধী-বাম-নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে জোট গঠন হওয়ায় জনগণের সমর্থন মেলিনি। নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব জাতির কাছে স্পষ্ট হয়নি। ফলে ভোটাররা তাদের প্রতি হতাশ হয়েছেন। তাছাড়া ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে একথা উল্লেখ করে পীযুষ বলেন, নির্বাচন তো কখনই আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। সাধারণ মানুষ জোট নেতাদের এসব কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের কথা ও কাজে মিল ছিল না। রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল দুর্বল। সংলাপে প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিন্ড তৈরির আশ^াস দিলেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেই পুরো সময় কাটিয়েছে, কখনই আন্তরিকভাবে মাঠে নামেনি। ভোটের প্রয়োজনে মানুষের কাছেও যায়নি। ফ্রন্ট নেতাদের নির্বাচনে জেতার বিষয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না উল্লেখ করে এই অভিনেতা বলেন, তরুণ সমাজ দেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেন তা করেন। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হওয়ায় তরুণ সমাজ শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখে ভোট দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে তরুণ সমাজ বিএনপি-জামায়াত জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া সচেতন মানুষ বুঝতে পেরেছেন এটা বাংলাদেশ রক্ষার নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশ পরাজিত হবে। উন্নয়ন থমকে দাঁড়াবে। মাথাচড়া দিয়ে উঠবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে না। উন্নত দেশের প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে যাব। তাই ভোটাররা ভুল করেনি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে কাজ করেছে বিএনপির ক্ষেত্রে মানুষ তা দেখতে পায়নি।
×