ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহাসচিবের পদ রক্ষা নিয়ে শঙ্কা

ভোট বর্জন নিয়ে তোপের মুখে মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১ জানুয়ারি ২০১৯

ভোট বর্জন নিয়ে তোপের মুখে মির্জা ফখরুল

শরীফুল ইসলাম ॥ পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকার পরও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন না করায় দলের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ইতোমধ্যেই দলের একটি অংশ থেকে নির্বাচনে ভরাডুবির দায় নিয়ে মির্জা ফখরুলকে মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তিনি এখন মহাসচিবের পদ রক্ষা করতে পারবেন কি না তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। সূত্র জানায়, এবার বিএনপির নির্বাচনী কৌশল ছিল সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে সুবিধা আদায় করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকলে নির্বাচনের দিন বর্জনের ঘোষণা দেয়া। দলের নীতিনির্ধারনী ফোরামের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তই ছিল। সে ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন রাজি না হলেও বিএনপি ২০ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল। আর এ কারণেই দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা গাছাড়া ভাব নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের সহযোগিতায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির পূর্ব পরিকল্পনা ভু-ুল করে দেন। জানা যায়, এবার পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় নির্বাচনের ক’দিন আগেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নির্বাচন বর্জনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এ নিয়ে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তারেক রহমানও পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাসময়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলেন। সূত্র জানায়, পরিস্থিতি নাজুক মনে করে ভোটের দিন সকাল থেকেই বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এ সময় তারা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্জনের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে সবাইকে নির্বাচনী মাঠে থাকার পরামর্শ দেন। এ সময় মির্জা ফখরুল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার অবস্থানের কথা জানান। তখন ড. কামাল হোসেনও বর্জন না করে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার কথা বলেন। এদিকে সকালে ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে দলীয় পোলিং এজেন্ট না থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী মির্জা আব্বাস তার স্ত্রী ও ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী আফরোজা আব্বাস ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৩ আসনের প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ভোট না দিয়েই ফিরে আসেন। এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বিএনপি নেতাতর্মী ও প্রার্থীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে ৩০ ডিসেম্বর দুপুরের আগেই একে একে নির্বাচন বর্জন শুরু করেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। দুপুরের মধ্যেই বিএনপির অর্ধশতাধিক ও জামায়াতের ২৪ প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা মনে করেছিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি তা না করে এক পর্যায়ে নেতাদের ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। আর ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরে ভোটের মাঠে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু তার এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে আরও বেশ ক’জন প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। রাতে ভোটের ফলে যখন দেখা গেল ঘোষিত ২৯৮টি আসনে যেখানে আওয়ামী লীগ পায় ২৬৫টি আসন সেখানে বিএনপি বিজয়ী হয় মাত্র ৫টি আসনে। যা বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয়। যার কারণ ব্যাখ্যা করে কখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না বিএনপি। তবে ভোট চলাকালে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে বিএনপিকে এভাবে ভরাডুবির দায় নিতে হতো না। তাই মহাসচিবের কারণে বর্জনের ঘোষণা দিতে না পারায় বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর চরম ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। এদিকে ভোটের দিন দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলের নেতারা ভোট কারচুপির অভিযোগ করতে থাকেন। তারা বলেন, ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি ধানের শীষের ভোটারদেরও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ভোট শেষে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট ডাকাতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দলের সিনিয়র নেতারা বলতে থাকেন তাদের দল আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর এ কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় নির্বাচনে জেতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা অংশ নিচ্ছে না। এ কারণে দলীয় প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় তারা এ নির্বাচনকে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি। এছাড়া এ নির্বাচনে জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়া, মনোনয়ন বাণিজ্য, দলের চেয়ারপার্সন কারাবন্দী থাকা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে অবস্থান করা, বিভিন্ন মামলায় দলের অসংখ্য নেতাকর্মী আসামি থাকা ও দলে ঐক্য না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে স্বাভাবিকভাবেই এবারের নির্বাচন বিএনপির জন্য প্রতিকূল ছিল। আর এ কারণেই নির্বাচনের দিন ভোট বর্জনের কৌশল নিয়ে কর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকতে চেয়েছিল বিএনপির বেশিরভাগ নেতা। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কারণে তা সম্ভব হয়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকায় নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় ছিল না অধিকাংশ নেতাকর্মী। ভোটের মাঠে তৎপর না থেকে তারা দফায় দফায় অভিযোগের দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। আর অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপি কোন এজেন্টই দিতে পারেনি। কিছু কেন্দ্রে এজেন্ট নিয়োগ করলেও ভোট শুরুর পরপরই তারা কেন্দ্র ত্যাগ করে। মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন এক সূত্রে জানা যায়, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের নির্দেশনা ছিল বিএনপি যেন ভোট বর্জন না করে। এ কারণেই দলের অনেক নেতা বলার পরও মির্জা ফখরুল বর্জনের পথে না গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকেন। তবে এমন ভরাডুবি হবে তা আগে বুঝতে পারেননি মির্জা ফখরুল। তাহলে হয়ত তিনি অন্যরকম সিদ্ধান্তের দিকে যেতেন। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় ভোটের দিন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা না দিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আালমগীর এখন অনেকেরই তোপের মুখে। তার মহাসচিবের পদ থাকা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, অনেকেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে এ ভরাডুবির জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়ী করেছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের একাংশ আগে থেকেই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচনে থাকার পক্ষে ছিল। কিন্তু লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের অপর অংশ বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে শোচনীয় পরাজয় বরণের চেয়ে বর্জনই শ্রেয় মনে করে। এ বিষয়টি নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির যে অংশটি নির্বাচনে থাকার পক্ষে ছিল তাদের যুক্তি ছিল প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিছু আসন পেলে বিএনপি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদাসহ রাজনৈতিকভাবে একটা সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। এর ফলে বিএনপি ঘরে-বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকার পাশাপাশি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আর অপর পক্ষের যুক্তি ছিল যেভাবে মামলা-নির্যাতন চালিয়ে বিএনপিকে কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে তাতে নির্বাচনে থেকেও খুব বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে না।
×