ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী

যোগ্য প্রার্থী দিতে না পারায় বিএনপির ভরাডুবি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১ জানুয়ারি ২০১৯

যোগ্য প্রার্থী দিতে না পারায় বিএনপির ভরাডুবি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে না পারায় নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিএনপি সাতটি আসন পেয়েছে। এটা তাদের দোষেই হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি-সন্ত্রাস তাদের ভরাডুবির কারণ। জনগণ উন্নয়নের সুফল পেয়ে ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখেই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে তাদের জবাব দিয়েছে। সোমবার গণভবনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা ৩০ দেশের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এ নির্বাচনটা খুবই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এর আগে কখনও এতটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি। আমাদের জনগণ অবাধে ও ভীতিহীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে। আর নির্বাচনে কোনও অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশন বন্ধ করে দিত। মতবিনিয়মকালে তার সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. গওহর রিজভী, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট তারানা হালিম, উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। সভায় বিদেশী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা বিএনপির সাতটি আসন পাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় ও বিএনপি-জামায়াত জোটের শোচনীয় পরাজয়ের কারণগুলোও তুলে ধরেন তিনি। বিরোধীদের নিরাপত্তা বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হই তখন সকল মানুষেরই প্রধানমন্ত্রী। সবাইকে সুরক্ষা দেয়া আমার দায়িত্ব। ভোটের অধিকার মানুষের, ভোট দেয়ার সময় মানুষ যাকে ইচ্ছে তাকে দেবে। কিন্তু ভোটের পর সবাই সমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র অগ্রসর হচ্ছে। অতীতে মিলিটারি ডিক্টেটররা ক্ষমতায় বসেছে। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্ট থেকে। আমি-ই একমাত্র ব্যক্তি যে কি-না ক্যান্টনমেন্ট থেকে না এসে দেশ পরিচালনা করছি। আর গণতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ উন্নতি করতে পারেনি। আমি সব সময়-ই চিন্তা করেছি, জনগণ ভোট দিলে (ক্ষমতায়) থাকব, অন্যথায় থাকব না। বিএনপির পরাজয়ের কারণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনে বিএনপি সাতটি আসন পেয়েছে তাদের নিজেদের কারণে। নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের প্রধান কে হবে তা তারা দেখাতে পারেনি। আর আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেন খুবই ভাল। কিন্তু তিনি যখন তার দল গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন তখন থেকেই তাঁর নির্বাচন পরিচালনা করার ভাল অভিজ্ঞতা নেই, জেতারও কোন অভিজ্ঞতা নেই। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে বিএনপি আমলে দুর্নীতির কথাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, বিএনপি আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা ইত্যাদির কারণে মানুষ তাদের রিজেক্ট (প্রত্যাখ্যান) করেছে। আর আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি- তারা (বিএনপি-জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্ট) নির্বাচনী কোন কাজ করেনি। কয়েকজনের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও অনেকেই এ্যাক্টিভিটি না করে প্রোপাগান্ডা ছাড়া সেরকম কিছু করেনি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিএনপি তাদের জোটে মানবতাবিরোধীদের নমিনেশন দিয়েছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেই দলের ২৫ জনকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনয়ন দিয়েছে, এজন্য তাদের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। আর বিএনপির মূল লিডাররা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত এবং আদালতের রায়ে অভিযুক্ত। তাদের একজন কারাগারে ও অন্যজন পলাতক। সুতরাং তাদের মূল নেতৃত্বের অভাব ছিল। পরাজয়ের এটিও একটি কারণ। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ অভিযোগ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের উদ্দেশে করে প্রধানন্ত্রী বলেন, ভোটে কোন কারচুপি হয়নি। ভোটে কারচুপি হলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিত। ভোটের সময় মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অগণিত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। আমার তো মনে হয় অনেক ব্যবহার করলে ইন্টারনেট এমনিতেই স্লো হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের জন্য রাজনীতি করলে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আজকের পরাজিতরা যদি জনগণের জন্য রাজনীতি করে তাহলে তারাও আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমি সবাইকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছি। আলোচনা করেছি। তাদের দাবি শুনেছি। যাতে করে তারা নির্বাচনে অংশ নেয়। তাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ বিষয়ে আল জাজিরার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন, নির্বাচনের পরে কয় ঘণ্টা পার হয়েছে? ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আমরা কিন্তু এখনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরূপ কোন আচরণ করিনি। অথচ ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আমাদের কর্মীদের মেরেছিল। নারীদের ধর্ষণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে। আমাদের অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা কিন্তু তেমনটা করিনি। আমাদের নেতাকর্মীরা বিরোধী দলকে কোন হয়রানি করেনি। বরং বিরোধী দলের হামলায় আমাদের প্রায় ২০ নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও অভিযোগ করেন, বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে আমাদের কর্মীদের হত্যা করেছে। নির্যাতন চালিয়েছে। আগুন লাগানো, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা বিএনপি-জামায়াতের এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- আমরা কখনই মেনে নেব না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভিসা জটিলতা, ভিসা না দিয়ে তাদের আসতে না দেয়া বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকেই রাজনৈতিক দলের সদস্য। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের কারণে অনেকে আসতে পারেননি।’ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সংসদে সক্রিয় বিরোধী দল না থাকায় আপনি কি চিন্তিত? আপনি কি শঙ্কিত যে, আরও সহিংসতা হতে পারে? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সহিংসতা ঠেকাতে যেকোন পদক্ষেপ নেব। আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। সবাই রাজনৈতিক চর্চা করবে। কিন্তু আমরা সহিংসতা ও পেট্রোলবোমার রাজনীতি সমর্থন করব না। নতুন সরকার হিসেবে শপথ নিয়ে কাজ শুরুর পর কোন বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে- বিদেশী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, নতুন সরকারের আমলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং মানুষের কল্যাণই অগ্রাধিকার পাবে। দেশের জনগণ হলো প্রধান বিচারক। ভাল-মন্দ বিচার করেই জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে বিএনপির কম আসন পাওয়ার বিষয়ে উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। যারা নির্বাচনে পাস করার মতো প্রার্থী তাদের মনোনয়ন না দিয়ে টাকা নিয়ে অন্যদের মনোনয়ন দিয়েছে। উদাহরণ তুলে তিনি বলেন, ধামরাইয়ের বিএনপির জনপ্রিয় নেতা জিয়াউর রহমান, নারায়ণগঞ্জের তৈমুর আলম খন্দকার ও সিলেটের ইনাম আহমেদ চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে এমন কিছু নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে; যাদের এলাকার মানুষ চেনে না। এমনিভাবে সারাদেশেই কোন কোন স্থানে তিন চারজনও ছিল তাদের প্রার্থী। প্রকৃত পক্ষে কে নির্বাচন করতে পারবে সেটাই তাদের অনেক প্রার্থী বুঝেই উঠতে পারেনি। এ ছাড়াও তাদের আরও দুর্বলতা ছিল। যে কারণে ঐক্যফ্রন্টের এমন ভরাডুবি হয়েছে। ‘আপনার এ বিপুল বিজয়ের পেছনের ম্যাজিকটা কী?’ বিদেশী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ম্যাজিক কিছুই না। দেশের জনগণের কথা বিবেচনা করে দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে সেজন্য কাজ করেছি। গত ১০ বছরে দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষিতের হার বেড়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে ডিগ্রী পর্যন্ত মেয়েদের পড়াশোনা ফ্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুকে যাতে স্কুলে পাঠায় সে জন্য মায়ের মোবাইয়ে ফোনে টাকা পাঠানো হয়। এতে শিক্ষার হার বেড়েছে। যুবকদের জন্য চাকরির ব্যবস্থাসহ ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। বেসরকারী খাত উন্মুক্ত করার কারণে চাকরির সুযোগ বেড়েছে। এছাড়া মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে, ইত্যাদি কারণে বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যে কারণে মেজরিটি আসন আমরা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আপনার প্রত্যাশা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ করছি। তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আমার প্রত্যাশা, তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়া। তারা কতদিন অন্য একটি দেশে শরণার্থী হিসেবে জীবন যাপন করবে? বরং আন্তর্জাতিক মহলের উচিত তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা ও একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।’
×