ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর রেণু

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১ জানুয়ারি ২০১৯

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর রেণু

উজাড় হওয়া বাগানগুলোয় ফুল ফুটতে থাকে- পিপাসার্ত আকাশ মেঘ ছুঁয়ে যায়, ক্ষণিকের জন্যে পৃথিবী থমকে দাঁড়ায় মুহূর্তের জন্যে যেন পাথরও হেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ক্যানভাস আকাশের মতো বিশাল। এই আকাশ অনেক রঙে বর্ণিল। টুঙ্গিপাড়া থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সময়সীমায় বাঙালী নামক একটি প্রাচীন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পৃথিবীর মানচিত্রে তিনি জন্ম দিয়েছেন একটি নতুন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। শত শত বছর বিদেশী শক্তি দ্বারা নিপীড়িত, শাসিত বাঙালীর মধ্যে সঙ্গত কারণেই তৈরি হয়েছে সুবিধাবাদী শ্রেণী, কমেছে জাতির নিজস্ব আত্মবিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি জাতি রাষ্ট্র জন্ম যন্ত্রণায় যেমন লড়াই করতে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে, তেমনি লড়তে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের পা-চাটা সুবিধাবাদী বাঙালী গোষ্ঠীর সঙ্গেও। ঘরে ও বাইরের দুঃসহ এই লড়াইয়ে কেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিগত পিপাসার্ত আকাশ? কি রঙে কি ঢঙে ছুঁয়েছিল তাঁকে তার মিষ্টি মেঘ? যদিও এ বিষয়ে তিনি কখনোই উচ্চকিত নন, তবে এর কিছু খ-চিত্র আমরা পাই তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী তিনি শুরু করেছেন এইভাবে- ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে এসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ জনগণ, তাদের জন্য কিছু করতে পারা আর আদর্শের জন্য ত্যাগ এই মূলমন্ত্র নিয়েই শুরু হয় লেখা। তিনি লেখেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ এই লেখা শুরু হয় সম্ভবত ১৯৬৭ সালের ২য় অর্ধে রেণুর অনুপ্রেরণায়। তাঁর সহধর্মিণী, আত্মজীবনীর রেণু ব্যক্তি নারীর প্রয়োজনসমূহ অবদমিত করে আত্মস্থ করে নেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূলমন্ত্র। এই বইতে আমরা পাই- ‘একটি ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সঙ্গে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সঙ্গেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনের সঙ্গে আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।’ ‘রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘ংরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।” ‘বঙ্গবন্ধু আরও লেখেন, ‘আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’ আজমীর শরীফ ও আগ্রা হতে ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু কর্দপশূন্য, স্যুটকেসের সঙ্গে জামাকাপড়ও হারিয়েছেন। এই সময় নিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘এরপর ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। কাপড় জামাও নতুন করে বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। দিল্লী ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠিও দিয়েছিলাম। আব্বাকে বলতেই হবে। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। পরে বলেছিলেন, ‘বিদেশ যখন যাও বেশি কাপড় নেওয়া উচিত নয় এবং সাবধানে থাকতে হয়।’ ‘আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।’ টাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রেণু, অমঙ্গল অশ্রুজল কষ্টে লুকিয়ে রাখা রেণুর আকুতি, এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস। অসাধারণ প্রেমময় মুহূর্ত। শুধু এই একটি দৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে পৃথিবীর সেরা একটি চলচ্চিত্র। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট থেকে সেই চলচ্চিত্র অবশ্যই আমরা পাব। বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, রেণুর বিশ্বাস তিনি পাশে থাকলে তাঁর প্রিয় পুরুষটি পরীক্ষায় পাস করবেন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোট বোনের স্বামী বরিশালের এ্যাডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন পার্ক সার্কাসে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকত, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয় পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।‘ ঢাকা জেলের কথা মনে করতে গিয়ে লিখছেন- ‘একদিন আমার হাতের কব্জি সরে গিয়েছিল, পড়ে গিয়ে। ভীষণ যন্ত্রণা, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। আমাকে বোধহয় মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। একজন নতুন ডাক্তার ছিল জেলে। আমার হাতটা ঠিকমতো বসিয়ে দিল। ব্যথা সাথে সাথে কম হয়ে গেল। আর যাওয়া লাগল না। বাড়িতে আমার আব্বা ও মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রেণু তখন হাসিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাসিনা তখন একটু হাঁটতে শিখেছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন। রেণু জানত, আমি সিগারেট খাই। টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।’ প্রিয় পুরুষটির রাজনীতি আর সমাজ সেবা ছাড়া অন্য কোনদিকে মন নাই। উপার্জনহীন পিতার অর্থের ওপর নির্ভরশীল এমন প্রিয় পুরুষটির সিগারেটের টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল রেণু।’ পিতার কাছ থেকে সিগারেটের টাকা নিতে আত্মসম্মানে আঘাত লাগে রেণু’র। নিজের প্রয়োজন জলাঞ্জলি দিয়ে টাকা জমায়, টাকা পাঠায় প্রিয় পুরুষের শখ পূরণে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তার উল্টো যাত্রার পর তিনি লেখেন- ‘স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হয় না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচী। সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই। আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। আব্বা বললেন, ‘আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার।’ আমি আব্বাকে বললাম, ‘আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না।’ আমাকে আর কিছুই বললেন না। রেণু বলল, ‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে।’ আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনেছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়। আমি ঢাকায় রওনা হয়ে আসলাম। রেণুর শরীর খুব খারাপ দেখে এসেছিলাম। ইত্তেহাদের কাজটা আমার ছিল। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পেতাম, যদিও দৈনিক ইত্তেহাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। পূর্ব বাংলা সরকার প্রায়ই ব্যান্ড করে দিত। এজেন্টরা টাকা দেয় না। পূর্ব বাংলায় কাগজ যদিও বেশি চলত।’ গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে খুঁজছে, গ্রেফতারের সকল আয়োজন সম্পন্ন জেনেও গ্রেফতারের পূর্বে পরিবারের সাথে দেখা করতে চান। বেনাপোলে নেমে চেষ্টা করেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়ার। এই সময় তিনি লেখেন- ‘ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে, সেই জন্য আমার আরো বেশি ব্যথা লাগে। মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাসিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’ প্রেমিক বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় নারীর প্রতি অনুভূতির উচ্চকিত প্রকাশ এড়িয়েই গিয়েছেন, কিন্তু দয়িতার দহন তিনি তীব্রভাবেই অনুভব করেছেন, কষ্ট পেয়েছেন। এই কষ্ট লাঘবের সময় কাছে ছিল না বলে তাঁর কষ্ট তীব্রতর হলেও বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের স্বার্থে এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা একান্ত ব্যক্তিগত না পাওয়ার অক্ষমতা একে অপরের কাছে গোপন করেছেন সারাজীবন। তিনি লেখেন ‘রেণু বলল, ‘কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড়বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু’একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব। পরে আব্বা গিয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন।’ আমি রাজি হলাম, কারণ আমি তো জানি, এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না।’ বঙ্গবন্ধুর অর্থের প্রয়োজন মেটাতে সকল সময় তৈরি থাকা অন্নপূর্ণা রেণুকে নিয়ে তিনি লেখেন ‘আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, ‘এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দুইজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হবে ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজো বোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব।’ ‘রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমো দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি।’ বিদায়ের সময় রেণু নীরবে চোখের পানি ফেলছেন- প্রেমিক বঙ্গবন্ধু, স্বামী বঙ্গবন্ধু কোন সান্ত¦না বা আশার বাণী শোনাতে পারছেন না, তাঁর এই অসহায়ত্ব তিনি প্রকাশ করেছেন শুধুমাত্র প্রেমময় একটি চুম্বন দিয়ে। সবই তো ওকে বলেছি, এই আকুতি, এই নিবেদন, প্রিয় নারীর কাছে আত্মসমর্পণের এই চিত্র মহানায়ককে প্রেমিক হিসোবে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এ প্রেমিকের নিজস্ব নারীটি সময়ের পরিক্রমায় বড় বেশি দায়িত্ববান হয়ে ওঠেন, মা হিসেবে, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে। রেণুর সংসার বড় হচ্ছে। গ্রেফতারকৃত বঙ্গবন্ধুর বিচার কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে, রেণুর উদ্বেগে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু লেখেন- ‘বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছি। রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, ‘ভুলে যেওনা, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।’ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাসু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাসু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে থাকতে পারি বলে কয়েক ঘণ্টা ওদের সাথে থাকতে সুযোগ পেতাম।’ ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউই নাই। ছোটবেলায় বাবা মা মারা গেছেন, আমার কেউ নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টো। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাসু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে গিয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’ পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হলো।’ আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু সমস্ত জেলায় ঘুরে সংগঠনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এই সময় তিনি লিখেন- ‘ল পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসন্তুষ্ট, টাকা পয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে! রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। চলবে... লেখক : আইনজীবী
×