ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১ জানুয়ারি ২০১৯

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর। বিজয়ের মাসের শেষার্ধে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সুদূরপ্রসারীও বটে। রাজধানী ও মাঠ পর্যায় থেকে যেসব খবরাখবর পাওয়া গেছে তাতে প্রতীয়মান হয়, নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দলমত নির্বিশেষ সব ধর্ম ও মতের মানুষ দলবেঁধে নির্বাচন কেন্দ্রে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। অবশ্য কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্র ভাংচুর, দখলের অপচেষ্টা, ব্যালটবাক্স ছিনতাই, জালভোট প্রদানের চেষ্টা ইত্যাদির অভিযোগও শোনা গেছে। কমবেশি সন্ত্রাস-সহিংসতাসহ গুলিবর্ষণ এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, নিহতের সংখ্যা ২২ জন। আহতের সংখ্যা চার শতাধিক এবং ভাংচুর হয়েছে কয়েকটি কেন্দ্র। ২২টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ২৯৯টি আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪০ হাজার ৫১টি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়, প্রায় দু’হাজার। এর মধ্যে জোট, মহাজোট এবং ঐক্যফ্রন্টও আছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, এবারের নির্বাচন হয়েছে অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। সে ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-রেষারেষিসহ কেন্দ্র দখলের একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা কাজ করবে সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। তদুপরি অতীতের মতো এবারের নির্বাচনেও বিরোধীদের পেশিশক্তি, সঙ্ঘশক্তি সর্বোপরি সাদা-কালো টাকার খেলা প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিএনপি-জামায়াত ২০ দলীয় জোট এবং এর পৃষ্ঠপোষক ঐক্যফ্রন্টের পেছনে পাকিস্তানী কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ বিদেশী টাকা আসার খবরটিও ওপেন সিক্রেট। এ সংক্রান্ত পারস্পরিক মোবাইল সংলাপের অডিও ক্যাসেটও সহজলভ্য। নির্বাচনে প্রায় ভরাডুবির আশঙ্কায় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি-জামায়াতের শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বানচাল অথবা বর্জনের চেষ্টাও ছিল সর্বদাই। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের সর্বাত্মক আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দাবাহিনীর নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সহিংসতা একেবারে এড়ানো যায়নি, যা খুবই দুঃখজনক, অগ্রহণযোগ্য ও মর্মান্তিক। স্বাধীনতার ৪৭ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বিশেষ করে বিজয়ের মাসে এমনটি কারও কাম্য ছিল না। তবে এও সত্য যে, এবারের এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটি ছিল বর্তমান সরকারের জন্য প্রকৃতই এক অগ্নিপরীক্ষা। ২০১৪-এর দশম সংসদ নির্বাচন ২০ দলীয় জোট বর্জন করায় এবং সরকারের ১৫৩ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় স্বভাবতই বর্তমান সরকারকে কিছুটা নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। ২০১৮-এর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার অতীতের সেই বিতর্ক অতিক্রম করতে পেরেছে। এর পাশাপাশি এও বলতে হয় যে, জামায়াত অধ্যুষিত ২০ দলীয় জোট অতীতের সেই সহিংসতা, পেট্রোলবোমা, আগুন সন্ত্রাসে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার জিঘাংসা থেকে আদৌ মুক্ত হতে পারেনি। আর তাই শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের উদ্যোগ ও আহ্বানে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিলেও জ্বালাও-পোড়াও-সন্ত্রাসের পথ থেকে সরে আসতে পারেনি। আর প্রধানত এই কারণেই বলা যায়, নির্বাচনী সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যে বা যারা নিহত হয়েছে তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ও সমর্থক। এ থেকে এটিও পরিষ্কার-নির্বাচন কমিশনে অনিবন্ধিত এবং দলীয় চাঁইদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হলেও তাদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙ্গে যায়নি। সেক্ষেত্রে এই বিষদাঁত সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলার এখনই সময়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ১৯৭০ সালের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। সত্তরের নির্বাচন ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুতের। আর ২০১৮-এর নির্বাচন হলো স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি প্রতিরোধ এবং বাঙালী কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। আশার কথা এই যে, শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, শিল্পী-কলাকুশলী, ব্যবসায়ী শ্রেণী, প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক-বাহক, তরুণ সমাজসহ প্রায় সবাই বর্তমান সরকারকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেছেন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর অচিরেই নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করবে। তাদের অন্যতম কাজ হবে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
×