ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্যই শেষ কথা নয়

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

 সাফল্যই শেষ কথা নয়

সব পারতে হবে আমায়। জানতে হবে সব। লক্ষ্যটাই চূড়ান্ত। বাকি সমস্ত কিছুই ফিকে। আমিই হব সকল কৃতিত্বের ভাগীদার। অর্থ, বিত্ত, সম্মান সব কিছুই আমার চাই। সবার চেয়ে বেশি। এ জন্য যতই কষ্ট হোক। তবু সিঁড়ি বেয়ে সবচেয়ে উঁচুতে উঠতেই হবে। ক্ষতি হোক শরীর ও মনের। সাফল্য আমার চাই। জীবনে সফল হওয়া মানে কি একেবারে শীর্ষে ওঠা? একটু রয়ে সয়ে সফল হলে ক্ষতি কি? এতে শরীর ও মন দুটোই বাঁচবে। আপনারও দেখা হবে জীবনের অন্য সব দিকগুলো। আমি কেন এটা হতে পারলাম না, ওটা হতে পারলাম না। স্বপ্ন আর পাওয়ার সিঁড়ি কখনই যেন শেষ হতে চায় না। সবচেয়ে উঁচুতে ওঠার সেই বেদীতে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকে অনন্দ পান বটে, কিন্তু তারা জীবনকে করে তোলেন চাপগ্রস্ত। ক্লান্ত, শ্রান্ত জীবন পরিণত হয় অভ্যাসে। তারা বঞ্চিত হন জীবনের অন্য প্রান্তে পড়ে থাকা সকল আনন্দ, দুঃখ, বেদনার অভিজ্ঞতা থেকে। দুশ্চিন্তায় পেটে গিট পাকিয়ে ওঠা, টেনশনে ঘাড় ব্যথা, গলা ও ঘাড় চাপগ্রস্ত হওয়া, ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ চড়ে যাওয়া, চোয়ালের পেশী শক্ত হওয়া, দাঁত কিড়মিড় করা এসব শারীরিক উপসর্গ জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। এরপর তা পরে পেপটিক আলসার, ইরিটেবল বাওয়েল- এসব রোগের সৃষ্টি করে। পরিশ্রম শারীরিক-মানসিক দুই রকমই হতে পারে। স্বাভাবিক পরিশ্রমে ঘুম আসে কিন্তু অতি মাত্রায় পরিশ্রম ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। দিনের বেলায় বহু লোক মানসিক চাপে ভোগেন, তাদের স্নায়ু উত্তেজিত থাকে এবং তারা এত বেশি কাজ করে যা তাদের শরীরে সয় না। ফলে তারা তাড়াতাড়ি খুব বেশি শ্রান্ত হয়ে পড়েন এবং এই অত্যধিক শ্রান্তির দরুন তাদের নার্ভাস সিস্টেম খুব বেশি উদ্দীপিত হয়। তখন ঘুম আসতে চায় না। তারা যখন ঘুমানোর চেষ্টা করেন তখনও তাদের মস্তিষ্কে কাজের চাকা ঘুরতে থাকে। বহু ক্ষেত্রেই অধিক কর্মব্যস্ত মানুষ যেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন অমনি তার মস্তিষ্কের ক্রিয়া কমার বদলে বেড়ে যায় এবং তা আগের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ দিনের বেলায় চারপাশের শব্দে যে বিঘ্ন ঘটত, রাতে সে বিঘœ আর ঘটে না। ফলে সে গভীরভাবে বিষয়টির মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। আবার দিনের বেলায় অতিরিক্ত টেনশন আর কাজের চাপে সময় মতো খাওয়া হয় না। অনেক সময় খাওয়ার কথা মনেই থাকে না। তাই তারা যখন রাতে খেতে বসেন খাবার মাত্রা যায় বেড়ে। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। দিনের অতিরিক্ত খাবার যতটা না শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ তার চেয়ে অধিক ক্ষতির কারণ রাতের অতিভোজন। রাতে বেশি খেলে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, গোটা শরীরে অস্বস্তি বোধ হয়, এবং অনিদ্রা হেতু হয়ে দাঁড়ায়। ক্যালরি খরচ কম হয়। যার ফলে ওজন বেড়ে যায়, উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয় যা ধীরে ধীরে হৃদরোগের কারণেও পরিণত হতে পারে। আপনার কাজের একটা তালিকা তৈরি করুন। কোন্ কাজগুলো অবশ্য করণীয় আর কোন্গুলো না করলেও চলে তার একটা চার্ট করে রাখুন। অনেক সময় আমরা কোন কিছু চিন্তাভাবনা না করেই যন্ত্রের মতো কাজ করে চলি। এমন কিছু কাজ করি যা করার আদৌ কোন দরকার নেই। আবার মাঝে মাঝে এলোমেলো যদিচ্ছাভাবেও কাজ করি যাতে অযথা সময় ও শক্তি ক্ষয় হয়, টেনশন বাড়ে। অথচ একটু চিন্তা করে পরিকল্পনা মতো চললে অনেক কাজই সহজে সুষ্ঠুভাবে করা যেতে পারে। সফলতার পেছনে যারা হন্যে হয়ে ছোটেন তাদের একটি সমস্যা হলো সবকিছু তাদের চাই। যতটুকু উঁচুতে ওঠা এদের স্বপ্ন সে স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণ হওয়া চাই। অতি আশা করা এবং তা অর্জনের জন্য শরীর পাত করে পরিশ্রম করার আকাক্সক্ষা পূরণের এই চেষ্টা বোধ হয় এত স্বাস্থ্যকর নয়। জীবনে সাফল্যের জন্য চেষ্টা তো করতেই হবে, শ্রমও প্রয়োজন, চাপও হবে জীবনের সঙ্গী- কিন্তু তারও একটা মাত্রা থাকা চাই। চাপের মুখে নিচেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সুস্থ শরীর ধরে রাখার জন্য চাপ কমাবার কিছু কৌশল জানা চাই। যার একটি ধাপ হলো ‘যেতে দেওয়া শেখা’। জীবনে অর্জনের শেষ নির্যাসটি ও নিংড়ে নিতে হবে, এমন কথা নেই। কিছু ছাড় দিতে হয়। তবে ছাড় দেয়া বলা যত সহজ কাজে পরিণত করা তত সহজ নয়। একজন সফল ব্যক্তির ভেতরে তাগিদ থাকে আরও, আরও অর্জন। কিন্তু এই সফল ব্যক্তিকে যদি বেঁচে থাকতে হয় তাহলে একটি স্থানে তাকে থামতে হবে, ছাড় দিতে হবে। নিজেকে অতিমানব ভাবার প্রয়োজন নেই। সবাইকে হারিয়ে, সব শক্তিকে একত্র করে নিজেই সব কাজ করা যাবে নিজেকে এমন ভাবার দরকার নেই। কিছু কিছু কাজের ভার অন্যকে দেয়া এবং তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া- একটি বড় কৌশল। এই কৌশল রপ্ত করতে সময় লাগে। ছোটখাটো দায়িত্ব বা কাজ অন্যদের ভাগ করে দিন- হয়ত এতদিন যেগুলো নিজেই করেছেন। দেখবেন আপনার অধঃস্তন ব্যক্তি/সহকর্মী/ কাজের লোক এরা বেশ ভালই করেছে। সন্তুষ্টি হয়েছে আপনার। আপনার সঙ্গের ব্যক্তিরাও বিষয়টিতে খুশি। এমনও হতে পারে কিছু বিষয়ে তারা আপনার চেয়েও ভাল করেছে। অথবা এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করেছে যা কাজটিকে আরও সহজ, সরল এবং স্বল্প সময়ে করার উপযুক্ত করে তুলছে। যা আপনার অভিজ্ঞতাকে আরও শাণিত করবে। আজকাল হচ্ছে ‘পার্টিসিপেটিং ম্যানেজমেন্ট’-এর যুগ। সুতরাং সেই তালে তাল মিলিয়ে চলুন। শরীরে যে অতিরিক্ত ভার বহন করছেন তার কিছুটা ছেঁটে ফেলে দিন এভাবেই। আবার জীবনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যেও ছাড় দেয়ার কিছু ব্যাপার আছে। হয়ত দুটো বিষয়ে একসঙ্গে শীর্ষে ওঠার। প্রিন্সটনের মনোবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া ক্যারিংটন একটি সহজ পদ্ধতি বলেছেন- ‘ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়া’ এ জন্য চর্চা প্রয়োজন। ক্যারিংটন বলেন ‘রিলিজ’ এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়। সব সফলতার পেছনে পরিশ্রম, চাপ ক্লান্তি থাকবেই। কিন্তু এই চাপকে একটু কি হাল্কা করা যায়? চাপকে মোকাবেলা করে, এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জীবনকেও কি সফল করে তোলা যায় না? শ্রম ও অর্জন দুটোই যেমন মনে প্রশান্তি আনে। তেমনি এতে জীবনের ওপর চাপও পড়ে কম। চেষ্টা করতে হবে এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য আনার। শত কাজের মাঝেও নিজেকে রিলাক্স রাখার চেষ্টা করুন। ধ্যানভ্যাস, ইয়োগা, পর্যায়ক্রমে পেশীকে রিলাক্স, বায়োফিডব্যাক রিলাক্স করার কৌশল আয়ত্ত করুন। প্রাণ খুলে হাসুন। মনের চাপ উড়িয়ে দিতে হাসিই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। যা মুখম-লকে আলোকিত করে, পেশীকে রিলাক্স করে পুনর্স্থাপিত করে। যখনই দেখবেন নিজের ওপর অতিরিক্ত চাপ আসছে। মনের ওপর পেশার পড়ছে। যেখানেই থাকুন না কেন দাঁড়িয়ে যান। লম্বা দম নিন দম ছাড়ুন। শিশুর মতো করে দম নিন। যাতে আপনার পেট ওঠানামা করে।
×