ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর দুই আসনে এই পদ্ধতিতে ভোট

ইভিএমে দ্রুত ভোট দ্রুত ফল, ভোটাররা খুশি

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

  ইভিএমে দ্রুত ভোট দ্রুত ফল, ভোটাররা খুশি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) আঙ্গুলে ছাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের মনিটরে ছবিসহ ভোটারের সকল তথ্য ভেসে ওঠে। এভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই শেষে ভোটার তালিকায় ভোটারের স্বাক্ষর নেয়া হয়। নির্দিষ্ট কেন্দ্র ও বুথের ভোটার নিশ্চিত হওয়ার পর ভোটারকে পাঠানো হয় গোপন কক্ষে। তারপর সেখানে ইলেক্ট্রনিক ব্যালট পেপার জ¦লে ওঠে। ভোটার তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে সাদা বাটন চাপেন। তারপর ভোটার যে প্রতীকে ভোট দিতে চান তা আবারও নিশ্চিত করা হয়। প্রতীক নিশ্চিত হলে ভোটার সবুজ বাটনে চাপ দিলেই ভোট চূড়ান্ত। তখন কম্পিটারের মনিটরে ভেসে ওঠে ভোট দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ সাদা বাটন হলো সিল মারা আর সবুজ বাটন হলো ব্যালট পেপার বাক্সে ফেলা। বুথে মোট ভোটারের মধ্যে কতজন ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন তাও দেখানো হয় কম্পিটারের মনিটরে। এভাবেই ইভিএম কেন্দ্রগুলোতে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। প্রথমবারের মতো রাজধানীর দুটি আসনে এই পদ্ধতিতে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। একজন ভোটার ভোট দিতে সর্বোচ্চ সময় লেগেছে ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ড। স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিয়ে ভোটাররা জানিয়েছেন, কাগজের ব্যালটের চেয়ে অনেক সহজ পদ্ধতি ইভিএম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। তারা বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সকল আসনে এই পদ্ধতিতে ভোট নেয়ার। এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে পেরে খুব ভাল লাগছে। খুব সুন্দরভাবে ভোট দিতে পেরেছি। এ পদ্ধতিটা বেশ সহজ। এমনকি মার্কা সিলেকশন করতেও কোন সমস্যা হচ্ছে না। দ্রুত ভোট দেয়া যাচ্ছে। ইভিএমের জন্য নির্বাচিত আসনগুলো হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সূত্রাপুর ও গে-ারিয়া এলাকার ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৬ আসন ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মোহাম্মদপুর এলাকার ৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩। এবার ঢাকা-৬ আসনের ৯৮টি ও ভোটকক্ষের সংখ্যা ৬৩৮। এবং ঢাকা-১৩ আসনের ১৩৪টি ও ভোটকক্ষের সংখ্যা ৮৭০। কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হয়। ঢাকা-৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৮। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার ১০৭, নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ২০৮ জন। ঢাকা-১৩ আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ১০। মোট ভোটার তিন লাখ ৭২ হাজার ৭৭৫। পুরুষ ভোটারের সংখ্যা এক লাখ ৯২ হাজার ৬০৭ ও নারী ভোটারের সংখ্যা এক লাখ ৮০ হাজার ১৬৮। দেশের মোট ছয়টি আসনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২, ঢাকা-৬ ও ১৩, চট্টগ্রাম-৯। ভোট শেষে এসব আসনে ফলাফলও হয়েছে দ্রুত। চারটায় নির্বাচন শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে রংপুর-৩ আসনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এতে বিজয়ী হয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সাবেক শিক্ষক প্রশান্ত বণিক চৌধুরী ৮১ বছর বয়সে তিনি প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেন। নারিন্দা এলাকার ফকিরচাঁন সরদার কমিউনিটি সেন্টারে ভোট দিয়ে তিনি জানান, আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো ইভিএম পদ্ধতি খুবই সহজ। সবাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে পারবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে। তবে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশের সকল আসনে এই পদ্ধতিতে ভোট হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় ফকিরচাঁন কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি বুথের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের টেবিলে একটি করে নমুনা ভোটিং মেশিন রাখা হয়েছে। যারা প্রশিক্ষণ ছাড়াই ভোট দিতে আসছেন তাদের প্রথমেই ভোট দেয়ার পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে নিমিষেই। তারপর আনুষ্ঠানিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট কানেকশন ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যাটারি চালিত ইভিএম মেশিনের প্রতিটিতে রয়েছে পোলিং কার্ড। ভোট দেয়ার পর সকল তথ্য এই কার্ডে জমা হয়। ভোট শেষে অডিট কার্ডে সকল পোলিং কার্ডের তথ্য যুক্ত করা হয়। তারপর অডিট কার্ড চাপ দিলেই কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠে কোন প্রতীকে কত ভোট পড়েছে। ফলাফল কাগজে প্রিন্ট নেয়ারও সুযোগ রয়েছে। এই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ৭৮০। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এক নম্বর কক্ষে ৩৯৩ ভোটারের মধ্যে ৪৪টি ভোট সম্পন্ন হয়। তিনি জানান, মেশিনে ভোটগ্রহণ ও গণনায় কারচুপির কোন সুযোগ নেই। সবকিছু ট্রান্সপারেন্ট। এবং প্রার্থীদের এজেন্টদের সামনেই কম্পিটারে সবকিছু করা হচ্ছে। যাতে কারো মনে কোন সন্দেহ তৈরি না হতে পারে। এই কেন্দ্রে ভোট দিয়ে আব্দুর রশীদ জানালেন, কখনও ভাবিনি এত সহজে ভোট দিতে পারব। আমি আগে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে আসার পর আর কোন সমস্যা হয়নি। একেবারেই সহজ। আমি চাই সব কেন্দ্রে এই পদ্ধতিতে ভোট হোক। মিল্টন নামে আরেক ভোটার জানান, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার পরই সব তথ্য কম্পিউটারে ভেসে উঠতে দেখি। তারপর ভোটার তালিকায় স্বাক্ষর করে গোপন কক্ষে গিয়ে সহজেই ভোট দিয়ে আসি। প্রথমে সাদা বাটনে চাপ দেয়ার পর প্রতীক নিশ্চিত কিনা তা স্পীকারের মাধ্যমে শোনানো হয়। তারপর সবুজ বাটনে চাপ দিলে ভোট নিশ্চিত হয়। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কর্মী-সমর্থক নিয়ে বসে থাকা ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারওয়ার হাসান আলী বলেন, সকালে ভোটার উপস্থিতি কম হয়। এটা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। দুপুরের পর থেকেই ভোটার সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে জানান তিনি। এরপর পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলসহ কয়েকটি কেন্দ্রে ঢুকতে গেলে বাধা দেয় লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর কয়েকজন সমর্থকরা। তারা বলেন, বড় ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে না। কিন্তু সে বড়ভাই কে। অনেক সময় কয়েকটি কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও তার খোঁজ মেলিনি। তারা বারবার সাংবাদিকদের এলাকা থেকে চলে যেতে বলেন। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের বাধা দেয়ার বিষয়টি জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদকে জানানো হলে তিনি বলেন, আজ কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া যাবে না। নিষেধ আছে। তোমরা চলে আস। এরপর তিনি তার টিকাটুলি কনকর্ড টাওয়ারের অফিসে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি। কবি নজরুল সরকারী কলেজে ভোট দিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানালেন, মোহন দাস। তিনি বলেন, সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে ভোট দিয়েছি। কোন ঝামেলা হয়নি। মেশিনেই ভোটগ্রহণ সহজ এমন দাবি করে তিনি বলেন, আমি ভোট দিয়ে খুশি। শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে ২৭ ও ২৮ দুটি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে একটি পুরুষ অন্যটি নারীদের জন্য। পুরুষ কেন্দ্রে রয়েছে পাঁচটি বুথ। এর মধ্যে তিনটি বুথেই লাইন দিয়ে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা গেছে। নারীদের উপস্থিতিও ছিল সন্তোষজনক। ইভিএম পদ্ধতিতে কিভাবে ভোটার চিহ্নত করা হচ্ছে। এর ব্যাখ্যা দিলেন ২৭ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার প্রকৌশলী শহিদুর রহমান খান। তিনি বলেন, তিনটি পদ্ধতি রয়েছে ভোটার চিহ্নিত করার। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, মেশিনে স্মার্ট আইডি কার্ড দিয়ে দ্বিতীয়টি যাদের স্মার্ট কার্ড নেই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর মেশিনে পুশ করলেই ভোটারের সার্বিক তথ্য ভেসে উঠবে। তিনি যদি এই কেন্দ্রের ভোটার না হন তাও মেশিনে দেখানো হয়। তৃতীয় পদ্ধতি হলো কেউ যদি জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্ড ছাড়াই ভোট দিতে আসেন তাদের ক্ষেত্রে মেশিনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিলেই তথ্য ভেসে ওঠে কম্পিউটারের পর্দায়। তারপর ১২ ডিজিটের নম্বর দিয়ে সার্চ করলেই জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর নিশ্চিত হওয়া যায়। তখন তিনি ভোট দেয়ার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ভোটারের তথ্য যাচাই শেষে ভোট প্রদানের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক। তাছাড়া কোন প্রার্থীর ফিঙ্গার না মিললে, যদি ছবি ও নাম ঠিকানা সব ঠিক থাকে তাহলে এজেন্টদের দেখিয়ে ভোটারকে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ভোট দেয়ার অনুমতি দিতে পারেন। এটি বিকল্প পদ্ধতি। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিন ধাপের সবকটিতেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক বলে জানান তিনি। তিনি জানান, এই কেন্দ্রে এক হাজার ৯৬৫ ভোটের মধ্যে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৩০০ বেশি ভোট দেয়া হয়। বলেন, ২৭ ডিসেম্বর প্রতীকী ভোট নিয়ে এই এলাকার ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাই সহজে সবাই ভোট দিতে পারছেন। তিনি জানান, ইন্টারনেট ও কোন ডিভাইস মেশিনে ব্যবহারের সুযোগ নেই। নেই সার্ভার কানেশনও। ব্যাটারি চালিত মেশিন দিয়ে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। এই কেন্দ্রে ১০টি মেশিন ব্যবহারের কথা জানান প্রিসাইডিং অফিসার। এই আসনে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরীর নামই জানেন না ভোটারদের অনেকে। কেন্দ্রের আশপাশে বিএনপির পক্ষ থেকে কোন বুথও চোখে পড়েনি। কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্রে এজেন্টের দেখাও মেলেনি খুব একটা। অর্থাৎ ভোটের মাঠে বিরোধী জোটের প্রার্থীদের উপস্থিতি, উত্তাপ কোন কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি।
×