ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান

একাত্তরের ইতিহাস, বাঙালীর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

একাত্তরের ইতিহাস, বাঙালীর ইতিহাস

সময়টা ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাহেবের কাছে। যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। নানা ব্যস্ততায় সময় যাচ্ছে। অনেক বার ভেবেছি, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তেমনভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না। তাই এবার বিজয়ের মাসে সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠান করতে হবে নতুন প্রজন্মকে লক্ষ্য স্থির করে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর থেকে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত টানা ১৫ বছর চলেছে আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত পরিকল্পিত নানামুখী কর্মকান্ড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, সংগ্রামের প্রিয় স্লোগান জয় বাংলার পরিবর্তে স্থান পেল পাকিস্তানী ভাবধারার স্লোগান বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ বেতার হলো রেডিও বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত রচিত সংবিধানের চার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ ধারার পরিবর্তন, উপেক্ষিত বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্থানে শিশুপার্ক নির্মাণ সর্বোপরি বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্থানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বাঙালী হিসেবে এ ভূ-খন্ডে রয়েছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সংগ্রামের ইতিহাস। এসবের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের যত স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা এবং আন্দোলন। আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য শত শত বছরের আন্দোলন সংগ্রাম-ত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের এ ভূ-খন্ডে বাঙালীদের আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয় আর সেটি হলো স্বাধীনতার আন্দোলন যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন জীবন ও বাস্তব সামাজিক অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে বেড়ে উঠেছেন তেমনি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য বাঙালীর মননশীলতা, শিল্প-সাহিত্যনির্ভর করে তাঁর লক্ষ্য স্থির করেছেন। একাত্তরে আমরা বলেছি, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান আমরা সবাই বাঙালী’। বাংলার অপরূপ প্রকৃতি, সমাজ, ঋতু পরিবর্তন, ক্ষেত-নদী, বন, জঙ্গল, পাহাড়-সমুদ্র থেকে শত শত বছরের বাঙালীর যে মন, ভালবাসা, দেশপ্রেম, স্বাধীনচেতা, ত্যাগের মহিমা, সৃজনশীলতা গড়ে উঠেছে, তার ফলশ্রুতিতেই আমাদের সকল চাওয়া- পাওয়া, কর্মকান্ড, আন্দোলন সংগ্রাম, লক্ষ্য স্বপ্ন স্থির হয়েছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমরা এ ভূ-খন্ডে মানুষ সবাই বাঙালী ছিলাম জাতি হিসেবে, জাতীয়তাবাদী হিসেবে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে দলমত নির্বিশেষে আবার ফিরে এসেছে সেই স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ‘আমি কে তুমি কে, বাঙালী, বাঙালী’। সেখানে চাকমা, মারমা, গারোসহ সব উপজাতির এ স্লোগানে একাত্ম হতে দেখেছি। কারণ, আমরা সবাই তো বাংলায় কথা কই। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী বিষয়টি নিয়ে এসে নতুন বির্তক সৃষ্টি করা হয়, মনে হয় আমাদের দ্বিখ-িত করার এক নতুন ষড়যন্ত্র। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশী থাকলেও বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি মুছে ফেলার ক্ষমতা কারও নেই বরং আরও তীব্রভাবে ফিরে আসছে বৈশাখে, উৎসবে, পূজা-পার্বণে সাহিত্য, সংস্কৃতি রীতি-নীতিতে বছর জুড়ে। ’৯০-এর ডিসেম্বরে এসে অনুভব করলাম গত পনেরো বছরে আমরা যে বাঙালী, আমাদের যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তা মুছে ফেলার চেষ্টা চলছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন প্রজন্মের জন্য এমন একটি অনুষ্ঠান করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর যেখানে ইতিহাসের সাক্ষীরাই থাকবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সভায় আমি প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে সবাই সমর্থন করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ পড়ার পর থেকেই ইচ্ছা ছিল সুযোগ পেলে জাহানারা ইমামকে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করার। সেই সুযোগ তৈরি হলো। ব্যক্তিগতভাবে অপরিচিত শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে অনুরোধ করলাম আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য। তিনি রাজি ছিলেন না। তিনি কখনও এ ধরনের অনুষ্ঠানে আসেননি। অনেক বলে কয়ে তাঁকে রাজি করালাম বিশেষ করে নতুন প্রজম্মের কথা বলে। অনুষ্ঠানটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০। অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ এম এ মাজেদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাহানারা ইমাম, শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বীর স্ত্রী ডাঃ জাহানারা রাব্বী, শহীদ ডাঃ আলিম চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী মিসেস পান্না কায়সার, বিএমএর সাবেক মহাসচিব ডা. সারওয়ার আলী, বিএমএর তৎকালীন মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন। বক্তব্য রেখেছিলেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও। সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক এম এ হাদী আর সঞ্চালনা করেছিলাম আমি। অনুষ্ঠানের দুদিন আগে থেকে প্রতিটি ক্লাসে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম উপস্থিত থাকার জন্য কারণ অনুষ্ঠানটি তাদের জন্যÑ তারা শুনবে শহীদ পরিবারের মুখে বেদনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় গাথা। সে দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ১নং গ্যালারিতে উপচেপড়া ভিড় হয়েছিল। ঢাকা শহর থেকে এসেছিল অসংখ্য চিকিৎসক। সম্মানিত সব ডাক্তার অসাধারণ বক্তব্যে বারবার আবেগপ্রবণ, উদ্বেলিত হয়েছে সভাস্থল। সে দিন সবাই সোচ্চার হয়েছিল, প্রতিজ্ঞা করেছিল অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। পনেরো বছর পর জাতীয় গণমাধ্যম টিভিতে এসব সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রথম বারের মতো সংবাদে ফলাও করে প্রচার করে যেখানে নিষিদ্ধ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে পায়। ’৯১-এর নির্বাচন পর্যন্ত আবার কিছুটা ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাঙালীর জীবন। ’৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত এই বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছিল প্রায় পাকিস্তান ভাবধারায়- সরকারে, রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। ’৯১-এর নির্বাচনের পর আবার ফিরে গেলাম ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে আবার নিষিদ্ধ হলো বঙ্গবন্ধু, নিষিদ্ধ হলো মুক্তিযুদ্ধ, নিষিদ্ধ হলো বাঙালী জাতীয়তাবাদ। ’৯৬-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবার ফিরে আসে বাংলার প্রাণ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের উন্নয়নের সঠিক ধারা। ২০০১-এর নির্বাচনের পর আবার ফিরে আসে ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীদের ভয়াবহ তা-ব, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, আবার পাকিস্তানের ভাবধারা। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে- আবার ফিরে আসে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্নয়নের ব্যাপক ধারা, বাঙালীর শাশ্বত জীবন। এ বিজয়ের মাসে গতকাল ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য, স্বাধীনতাবিরোধী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য, বিপুল উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিকল্প খোঁজার কোন সুযোগ নেই। তাই তরুণ প্রজন্মসহ সকল শ্রেণীর ভোটাররা মুক্তিযুদোধর পক্ষের শক্তি মহাজোটকেই ভোট দিয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও ফলাফল ঘোষিত হয়নি। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট আবার ক্ষমতায় আসছে তার আভাস মিলছে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্ত ক্ষমতায় আসুক, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই প্রত্যাশা থাকবে। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি বিশেষ করে ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, বাঙালীর অকাতরে জীবনদানের ইতিহাস। নতুন প্রজন্ম পাঠ্য বই ছাড়া অন্য বই পড়তে অনেকটাই বিমুখ। ইতিহাসের সাক্ষীরা একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের গৌরবের, প্রেরণার ইতিহাস প্রবাহিত করা আমাদের সবারই দায়িত্ব। বাঙালী মানেই বঙ্গবন্ধু। বাঙালী মানেই রবি ঠাকুর-নজরুল-জীবনানন্দ, বাঙালী মানেই মায়ের মুখের সুমধুর ভাষা, বাঙালী মানেই পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, বাঙালী মানেই ২৩ বছরের সংগ্রাম-আন্দোলন, বাঙালী মানেই মাথা নত না করা, বাঙালী মানেই মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালী মানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এসব মুছে ফেলতে হলে বাঙালী শব্দটাই মুছে ফেলতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী তাই এ শব্দ মুছে ফেলার সব আয়োজন করেছে- করবে। ১৯৯০-এর ১৮ ডিসেম্বরের বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য আয়েজিত সে অনুষ্ঠানটির মূল শিরোনাম ছিল ‘একাত্তরের ইতিহাস, বাঙালীর ইতিহাস’। লেখক : সাবেক উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×