ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা চলচ্চিত্রের মহীরুহ মৃণাল সেনের জীবনাবসান

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলা চলচ্চিত্রের মহীরুহ মৃণাল সেনের জীবনাবসান

সব্যসাচী দাশ ॥ উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন আর নেই। খ্যতিমান এই নির্মাতার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রবিবার সকাল সাড়ে দশটা দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। শেষের দিকে হারিয়ে ফেলেছিলেন স্মৃতিশক্তি। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্ম অবিভক্ত পূর্ব বাংলার ফরিদপুরে ১৪ মে ১৯২৩ সালে। পদ্মভূষণ সম্মান লাভ করেন ১৯৮৩ সালে। তার প্রয়াণে শোকের ছায়া চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ১৯৫৫ সালে ‘রাত ভোর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু মৃণাল সেনের। ওই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার। প্রথম চলচ্চিত্রে খুব একটা সাফল্য না পেলেও দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’-তে জাত চেনান তিনি। এরপর ‘বাইশে শ্রাবণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি মেলে মৃণাল সেনের। ‘ভুবনসোম’, ‘কোরাস’, ‘মৃগায়া’, ‘অকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘ক্যালকাটা ৭১’ মতো চলচ্চিত্রগুলো চিরকাল সিনেপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে থাকবে। এই চলচ্চিত্রগুলো জাতীয় পুরস্কার এনে দিয়েছে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। শেষবার ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়েছিন ২০০২ সালে ছবির নাম ‘আমার ভুবন’। জাতীয় পুরস্করের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন চলচ্চিত্রের এই মহীরূহ। ‘কোরাস’, ‘পরশুরাম’ চলচ্চিত্রের জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ‘সিলভার প্রাইজ পেয়েছেন মৃণাল সেন। মস্কোর পাশাপাশি, বার্লিন, ভেনিস, কান শিকাগো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও সম্মানিত হন তিনি। ‘খারিজ’ চলচ্চিত্রের জন্য কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার পান মৃণাল সেন। মনুষ্য জীবন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে আজীবন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন এই খ্যাতিমান নির্মাতা। রাজনীতির দরিদ্রতা, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য এবং বিরোধিতা, সমাজ-সংসারে নারীর পশ্চাত অবস্থান, শহর জীবনের নানা ক্লেদ মানব সভ্যতার নানমুখী সঙ্কট, খেটে খাওয় মানুষের জীবন থেকে শুরু করে সরকারী আমলার বিলাসী জীবন এসবই ছিল তার চলচ্চিত্রের বিষয়। সত্যকে তিনি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করতেন। অস্তিত্ববাদের সারাত্সার দিয়ে তার চলচ্চিত্রের বিষয় কাহিনী ব্যাষ্টিক দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তাতে সমাজের সমষ্টির অন্যান্য বিষয়ও চলে এসেছে। তার স্বীয় প্রবণাতাকে বাংলা চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক-প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের প্রবক্তা হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে। তার চলচ্চিত্র নির্মাণ ধারায় ইতালীয় নব্যবাস্তববাদের ভেতরকার উপকরণ ও ফরাসী নবতরঙ্গের প্রভাব স্পষ্ট; চেখভ্-ব্রেখট্-চ্যাপলিনের গল্প-নাটক-চলচ্চিত্র উপস্থাপনের রীতির উপস্থিতিও দেখা যায়। উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ বাস্তবতায় মানবদরদি শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি নিজের অজান্তেই স্ব-সময় ও সমাজের কথক হয়ে উঠেছিলেন। তার চলচ্চিত্রের শেষে কোন একক সমাধানের সন্ধান মেলে না। তিনি দর্শকের ওপর ছেড়ে দেন সমাধান খুঁজে নেয়ার ভার। বাংলা তথা উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র যে ক’জন বাঙালী পরিচালকের হাত ধরে বিশ্বদরবারে সম্মানের সঙ্গে আসীন হয়েছে তাদের মধ্যে মৃণাল সেন্য অন্যতম। চলচ্চিত্র শিল্পের এই মহীরূহের প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ দুই দেশের শিল্পাঙ্গন। চলচ্চিত্রের ক্যানভাসে তার স্বীয় দৃষ্টির যথাযথ বিশ্লেষণ মানুষ দীর্ঘদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।
×