ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বলো বলো সবে বলোরে বাঙালীর জয়

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

বলো বলো সবে বলোরে বাঙালীর জয়

বিজয়ের মাসের শেষ প্রান্তে এসে বাঙালী আরেকবার বিজয় অর্জন করে প্রমাণ করেছে, জাতি হিসেবে সে ভীরু নয়। আলস্য আক্রান্ত জাতিও নয়। বরং ‘চির উন্নত মমশির’ ধারণ করে সাহসের বরাভয় কাঁধে এগিয়ে যাচ্ছে সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে চুরে। সহস্র বছরের পরাজিত, নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল ১৯৭১ সালে। ১৬ ডিসেম্বর দখলদার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এই বাংলার মাটিতে। আর ২০১৮ সালের ত্রিশে ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে বাঙালীর আরেক বিজয় ঘটেছে ভোট যুদ্ধে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানী মানসিকতা ধারণকারীদের জনগণ ভোটযুদ্ধে হারিয়ে বিজয়ের মাসে ধরে রেখেছে বাঙালীর বিজয়। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় বাঙালী জাতিকে ক্রমশ যে সাহসী থেকে যোদ্ধা জাতিতে পরিণত করেছেন, সেই জাতি নানা বিপর্যয়ে ভুগলেও সাহস হারায় না। শেখ হাসিনা সেই সাহস যুগিয়েছেন। ১৯৭০-এর পর বাঙালী জাতি আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ২০১৮ সালে। সেবারও ছিল দেশজুড়ে শেখ মুজিবের নৌকার জয়জয়কার। যার পরিণতিতে এসেছিল স্বাধীনতা। আর ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার নৌকার আবার জয়জয়কার সারাদেশে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ একটি দ-ে একাত্ম হয়েছিল। তারা চেয়েছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সুফলগুলো সংরক্ষণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিনাশ। জাতি এই প্রশ্নে এক হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিশ্ববাসীও চেয়েছে শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় আসুক। ত্রিশে ডিসেম্বর ছিল বাঙালী জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন নির্ধারিত হয়েছে কারা পাচ্ছেন আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। দেশের ২৯৯ আসনে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ হয়েছে। নিñিদ্র নিরাপত্তার ভেতর দিয়ে নির্বাচন হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিয়ে নিরাপদেই বাড়ি ফিরতে পেরেছে। পছন্দের প্রার্থীকে ভোটদানে কোথাও তেমন বাধা পায়নি ভোটাররা। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েও নির্বাচন ভ-ুল করতে পারেনি। ত্রিশে ডিসেম্বর সারাদেশের সব পথ এসে মিশেছিল ভোট কেন্দ্রে। নারী, পুরুষ উৎসবের আঙ্গিকে, উৎসবমুখর চেতনায় ভোট কেন্দ্রে এসেছিল। তারা জানত, জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হবে তার একটি ভোটেই। দিনটি নতুন ও তরুণ ভোটারদের কাছে ঐতিহাসিক দিন হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রবীণদের কাছে এই নির্বাচন ছিল সত্তর সালের নির্বাচনের সমতুল্য। ২০১৮ সালের নির্বাচন অতীতের মতো কোন চিরাচরিত নির্বাচন ছিল না। এই নির্বাচনে বাঙালী জাতি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী হিংস্র সাম্প্রদায়িক চক্রকে পর্যুদস্ত করেছে। বিজয়ী হয়েছে স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামো এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার গণতান্ত্রিক চেতনা। বর্ষীয়ানদের মতে, সত্তর সালের নির্বাচন ছিল স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম, এবারের নির্বাচন সেই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম। সেবার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এবার নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, অতীতে যাদের ভোট দিয়েছে এবং যারা সরকার গঠন করেছে, তারা স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ করেছে, তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা জুড়ে দিয়েছে। দেশদ্রোহীদের অনুসারীদের রাষ্ট্র ও প্রশাসনে ঠাঁই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে নস্যাত করার চক্রান্ত করেছে। এবার সেই যুদ্ধাপরাধীদের দলে ভিড়িয়ে তাদের হাতে মওলানা ভাসানীর প্রতীক ‘ধানের শীষ’ তুলে দেয়া হয়েছে। আর এই কাজে সহায়তা করেছেন ঐক্যফ্রন্ট নামক স্বাধীনতাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসনে সক্রিয় কামাল হোসেনের নেতৃত্ব। দেশাদ্রোহীদের গাড়িতে আবার স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াতে এবং দ-িত মানবতার শত্রু, দুর্নীতিবাজ, জঙ্গী ও ঘাতকদের অনুসারীদের ক্ষমতায় এনে ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু করতে চেয়েছেন খালেদার বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত পাকিস্তানী চেতনাধারী কামাল হোসেন। নানা কৌশল, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করেও তিনি তার কুশলতা প্রমাণ করতে পারেননি। বিএনপির পলাতক ও দ-িত আসামির আদেশ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করতে না পারলেও জামায়াত ও প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনীতির মাঠে পুনর্বাসন করতে পেরেছেন, জনগণ না চাইলেও। ‘নির্বাচন হবে না’ বলে সারাবিশ্বে প্রচার চালিয়েও কোন সুবিধা করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবির। ত্রিশে ডিসেম্বর সকালে ফার্মগেট তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভোট দিতে গিয়ে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি ও লাইনে দাঁড়ানো দেখে মনে সাহস বেড়েছে। এই কেন্দ্রে হাঙ্গামা হতে পারে বলে জামায়াত-বিএনপিরা গুজব ছড়িয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কোন আলামত দেখা যায়নি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। পূর্ব রাজাবাজার ও পশ্চিম রাজাবাজার কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অত্যধিক। প্রথম ভোট দিতে আসা তরুণী আহেলি দিলশান ভোট দিতে পেরে আনন্দিত। মা দিলশান আরা ভোট দিয়েছেন একই সঙ্গে। ধারণা হয়, এবার ভোট সত্তর শতাংশের বেশি পড়তে পারে। ঢাকার আরও কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে মনে হয়েছে, সারাদেশে অবিস্মরণীয় গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করতে পারি, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট বিজয়ী হচ্ছে। সারাদেশ হতে বিজয়ের সুবাতাস পাওয়া যাচ্ছে। ফরিদপুর সালিখা থেকে সাংবাদিক রেজা এনায়েত, কিশোরগঞ্জের নিকলী, বাজিতপুর থেকে সাংবাদিক সোহেল রানা টেলিফোনে জানান, তাদের আসনগুলোতে নারী-পুরুষ এমনকি শিশু-কিশোররাও ভোট কেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছে। এক উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্ট এবং সমর্থকরা নির্বিঘেœ কাজ করছে। কোথাও কেউ কাউকে বাঁধা দিচ্ছে না। জনকণ্ঠের নিয়মিত কলাম লেখক এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি চাঁদপুর-৪ আসনের প্রার্থী শফিকুর রহমান একমাত্র সাংবাদিক প্রার্থী। তাই সাংবাদিক সমাজের দৃষ্টি ও আকর্ষণ এই আসনের প্রতি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে। চাঁদপুর থেকে শফিকুর রহমানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট খাজা আহমদ মজুমদার জানান, কুয়াশাভেদ করে ভোটাররা সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছে। এখানে ধানের শীষ বা জামায়াতের প্রার্থী নেই। এবার ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হচ্ছেন সাংবাদিক শফিকুর রহমান। ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন তার নির্বাচনী প্রচারে। সাংবাদিক সমাজও চায় সংসদে অন্তত তাদের একজন প্রতিনিধি থাকুক। সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে সাতচল্লিশ বছর পর আরেকটি বিজয় সূচিত হতে যাচ্ছে। ২০১৮ খ্রিস্টীয় বর্ষের আজ শেষ দিন। আজ ৩১ ডিসেম্বর। রাত ১২টার পর আসবে নতুন বছর ২০১৯। সেই সঙ্গে নিয়ে আসবে নতুন সংসদ, নতুন সরকার, নতুন মন্ত্রিসভা। এক নতুনত্বের অবগাহনে জাতি আবার শুদ্ধ হতে থাকবে। বিদায় ২০১৮। স্বাগত ২০১৯। সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে আরেক বাংলাদেশের যাত্রা হবে শুরু। পশ্চাতে পড়ে থাকবে জঞ্জাল। বিদায়ী বছর ২০১৮ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন সময়ের বছর। এই সময়ের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেছে জাতি হিসেবে বাঙালীর অস্তিত্ব। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত থাকা না থাকা, পতাকা খামচে ধরা না ধরার শক্তিমত্তা, স্বাধীনতার ফিরে পাওয়া অর্জনের সুরক্ষা হবে কি হবে না- তা নির্ধারিত হয়েছে বছরের শেষে। বাঙালী জাতির জন্য বছরটি ছিল না ভাবাবেগের। বরং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এবং অর্জিত সাফল্য ধরে রাখার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বছর ছিল। ২০১৮ সাল বাঙালীর জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল। তাকে নির্ধারণ করতে হয়েছে পঁচাত্তর পরবর্তী পাকিস্তানী দাসত্ব মানসিকতায় দেশকে নিয়ে যাবে, নাকি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত তার প্রাণপ্রিয় স্বদেশকে বিশ্ব দরবারে আরও সগৌরবে দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করে দেবে, বাঙালী বীরের জাতি। এই বাঙালীই একাত্তর সালে গেয়েছিল এবং আজও ধ্বনিত হয় সেই গান-‘বলো বলো বলোরে সবে বলোরে বাঙালীর জয়/এই কথা বলিয়া নদীর বুকে গান গাহিয়া যাই।’ বাঙালী জানে তাকে পরাধীন সময়ে ফিরিয়ে নিতে কত ষড়যন্ত্র কত কুটিলতার জাল বোনা হয়েছে, অর্থকড়ি বিনিয়োগ করেছে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই গুপ্তহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দেশকে যারা ধ্বংস এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চেয়েছিল। গণহত্যাকারীদের ক্ষমতায় অংশীদার করেছিল, তাদের প্রতিহত করার বছর ছিল বৈকি ২০১৮। শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক দেশে, এটা সবারই কাম্য ছিল। হয়েছেও তাই। কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনা ছাড়া, সারাদেশে পরিবেশই ছিল শান্ত, সুশৃঙ্খল। কেন্দ্র দখল, মারামারি, কেন্দ্রে ভোটার আসায় বাধাদান, জালভোট জাতীয় দৃশ্যপট এবার তেমন মঞ্চস্থ হয়নি। অতীতে এসবই হয়ে উঠেছিল ভোটের অনুষঙ্গ। সামরিক শাসক জিয়া, এরশাদ আমলে নির্বাচন ছিল প্রহসনের নামান্তর। ‘মার্শাল ক্যু’ ও ‘মিডিয়া ক্যু’-এর মাধ্যমে ফল ঘোষণা করা হতো। প্রার্থী যা ভোটই পাক না কেন। এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯ দল যেমন অংশ নিয়েছে, তেমনি নিবন্ধিত নয় এমন দলগুলো জোটের আশ্রয়ে অংশ নেয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা যেমন মানে না, তেমনি আইনও। তাই দলটি নিবন্ধন পায়নি আইনগত কারণে। সেই দলের ২২ জন প্রার্থী বিএনপিতে যোগ না দিয়েও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থী হয়ে ভোটে অংশ নেয়। মিথ্যাচারে পারদর্শী দলটির তিনজন সদস্য স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেয়। দেশপ্রেমিক জনগণ এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আর জনগণের ঘৃণা তাই উপচে পড়ছে বিএনপির ওপর যেমন, তেমনি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক ঐক্যফ্রন্ট নেতা কামাল হোসেনও হয়ে গেছেন ঘৃণীত এক নাম। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে এসে বাঙালী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই এক যুদ্ধ বাঙালীর। বিজয়ের মাসে বিজয়ী বাঙালী তার ঐতিহ্য ধরে রাখবে ভাবিকালেও। বাঙালীর বিজয়কে কেউ রুখতে পারেনি, পারবে না। বর্ষ বিদায়কালে তাই বলে যেতে হয়, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।’
×