ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারানোর বেদনায় আরও একটি বছর

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

হারানোর বেদনায় আরও একটি বছর

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘আমার প্রহরগুলো সব আজ বেদনার স্রোতে ভেসে ভেসে বড্ড ক্লান্ত’ প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় সত্যি ক্লান্ত সবাই। বছরের শেষ প্রান্ত। এ বছর শিল্পাঙ্গনে হারানোর বেদনার পাল্লা যেন ভারি হলো। বছরজুড়েই ছিল শোকের মিছিল। বছরের শেষদিকে এসে হারানোর তালিকায় যুক্ত হলো বেশ কিছু গুণীজনের নাম। ভক্তদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তি গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু, নির্মাতা আমজাদ হোসেন, চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের মতো মানুষেরা। এবছর হারানোর তালিকায় রয়েছেন যারা- সিরাজ হায়দার : বছরের প্রথম শোক নেমে আসে অভিনেতা সিরাজ হায়দারের মৃত্যুতে। এ বছরের ১১ জানুয়ারি বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিমান ও জনপ্রিয় এই অভিনেতার মৃত্যু হয়। সেদিন ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৬টার দিকে রাজধানীর কল্যাণপুরে নিজ বাসায় মারা যান তিনি। শাম্মী আক্তার : কণ্ঠে ছিল যাদু। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে বহু কালজয়ী গান তিনি উপহার দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী শাম্মী আক্তার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ১৬ জানুয়ারি তার শরীর হঠাৎ বেশি খারাপ হলে হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। কাজী আজিজ আহমেদ : ৩০ জানুয়ারি মারা যান বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান গীতিকার কাজী আজিজ আহমেদ। ‘চোখ যে মনের কথা বলে’র মতো অসংখ্য গান তিনি লিখে গেছেন। পাশাপাশি বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। ছিলেন একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালকও। ঝুটন চৌধুরী : দীর্ঘদিন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান বিনোদন সাংবাদিক জুটন চৌধুরী। আলী আকবর রুপু : ডায়াবেটিস, হার্ট ও কিডনির অসুখসহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন গীতিকার ও সুরকার আলী আকবর রুপু। হঠাৎ তার শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় ভর্তি করা হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ২২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কবি বেলাল চৌধুরী : টানা কয়েকদিন লাইফসাপোর্টে থাকার পর ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর ১২-১ মিনিটে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মৃত্যু হয় কবি বেলাল চৌধুরীর। কবি বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নবেম্বর। সে হিসেবে প্রায় ৮০ বছরের জীবন তাঁর। কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত কিন্তু তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতা গিয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন। অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশী সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। তাজিন আহমেদ : ছোট পর্দার জনপ্রিয় তারকা তাজিন আহমেদ মারা যান ২২ মে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৩ বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে লাইফসাপোর্ট দেয়া হয়। অবশেষে বিকেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাজিন আহমেদ অভিনয়ের পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই নোয়াখালী জেলায় জন্ম নেয়া এই অভিনেত্রীর শুরুটা মঞ্চনাটক দিয়ে। এরপর ১৯৯১ সালে বিটিভির ‘চেতনা’ নামের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থাপনা শুরু করেন। তাকে বনানী কবরস্থানে তার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। রানী সরকার : চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রানী সরকার। একটা সময় চলচ্চিত্র থেকে দূরে ছিলেন। কাটিয়েছেন মানবেতর দিন। অর্থাভাবে ঘুরেছেন পথে পথে। ঠিকমতো পাননি চিকিৎসাও। জীবনের এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৮৬ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী বার্ধক্য ছাড়াও পিত্তথলির পাথর, বাতজ্বর, জটিল কোলেলিথিয়েসিস রোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। আব্দুস সাত্তার : বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের বর্ষিয়ান অভিনেতা আব্দুস সাত্তার এ বছরের ১৯ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রথম ‘আমির সওদাগর ভেলুয়া সুন্দরী’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া অসংখ্য নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির আজীবন সদস্য অভিনেতা আব্দুস সাত্তার দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ডায়াবেটিসসহ ১৩টি রোগের সমস্যা। সবকিছুকে ছাপিয়ে অবশেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান এই অভিনেতা। আইয়ুব বাচ্চু : তাঁর মৃত্যুর শোকের মাতম চলছে এখনও। দেশে-বিদেশে কোটি কোটি ভক্তরা আজও তার স্মৃতিচারণে মত্ত। কাঁদছেন তার সহকর্মীরা। বিরহে জ্বলছে তার প্রিয় রূপালি গীটারগুলো। গেল ১৮ অক্টোবর এলআরবির দলনেতা ও লিড গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু মারা যান। সেদিন নিজ বাসায় অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। এরপর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেখা যায় মানুষের ঢল। বাচ্চুকে চট্টগ্রামে তার মায়ের পাশে দাফন করা হয়। রঙ্গলাল দেব চৌধুরী : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুরদিন ১৮ অক্টোবর কানাডার টরন্টোর সেইন্ট মাইকেল হাসপাতালে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আনোয়ার হোসেন : বছরের শেষ মাসটির প্রথমদিন ১ ডিসেম্বর। আকস্মিক প্রচার হয় তার মৃত্যুর খবর। নেমে আসে শোক। পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনের একটি রুমে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন। আমজাদ হোসেন : যতদিন এই দেশে চলচ্চিত্র থাকবে ততদিন সম্মান ও শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হবে আমজাদ হোসেনের নাম। নির্মাণে, চিত্রনাট্যে ও গীতিকবিতায় তিনি রেখেছেন মুন্সিয়ানার ছাপ। তার ‘ভাত দে’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’ ছবিগুলো ঢাকাই সিনেমাকে গর্বিত করেছে। কালজয়ী এই নির্মাতা ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি ছিলেন একজন স্বনামধন্য লেখক। তার লেখা উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, গল্পসমগ্র মুগ্ধতা ছড়িয়েছে এদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে। বেশ কিছু চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন টিভি নাটকে। ‘জব্বার আলী’ সিরিজের নাটকগুলোতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করতেন তিনি। সাইদুল আনাম টুটুল : ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাইদুল আনাম টুটুল মৃত্যুবরণ করেন। রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাব এইডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ‘আধিয়ার’ খ্যাত এই নির্মাতা। মোহাম্মদ ইদ্রিস : জাতীয় প্রতীক শাপলার নকশাকার মোহাম্মদ ইদ্রিস মৃত্যুবরণ করেন ২২ ডিসেম্বর। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন, ফুসফুসে পানি জমেছিল। এ ছাড়া হার্ট এ্যাটাক হয়। সর্বশেষ আটদিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। অনেক বইয়ের প্রচ্ছদও তিনি এঁকেছেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর : প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর মারা যান রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসায় ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টায়। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর সৃষ্টিকর্মে বেশিরভাগ স্থান পেয়েছে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির দৃশ্য। তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে চারুকলা বিভাগ চালু করেন।
×