ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

নির্বাচন ও অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচন ও অর্থনীতি

প্রতিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। দশম সংসদ নির্বাচন বিরোধী দল বর্জনের পথ বেছে নেয়ায় ভোটের অর্থনীতিতে মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে এসেছে ততই স্ফীত হচ্ছে ভোটের অর্থনীতি। ভোটকে কেন্দ্র করে চায়ের পেয়ালায় ঝড় উঠছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই ঈদের কথা বাদ দিলে ‘সংসদ নির্বাচনী উৎসব’ই সবচেয়ে বড় উৎসব, যদিও তা পাঁচ বছর পরপর আসে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র্র্র করেও চাঙ্গা হয়ে ওঠে ভোটের অর্থনীতি। দশম সংসদ নির্বাচনে ভোটের অর্থনীতি মার খাওয়ার প্রধান কারণ অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা। ফলে টাকাও সেভাবে গ্রামাঞ্চলে যায়নি। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এ বছর যেন ঘরে ঘরে প্রার্থী। অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ীও এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র্র্র করে সারাদেশে নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়ছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ছাড়িয়ে যাবে ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রার্থীদের ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্পে বরাদ্দ, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা সংস্থার ব্যয়, ভাতা ও আনুষঙ্গিক কাজে বিপুল খরচ হবে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির তুলনায় এ ব্যয় বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বাজেট ছিল প্রায় ৫শ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সব আসনে নির্বাচন না হওয়ায় ব্যয় হয় ২৮৩ কোটি টাকা। এবারের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যয় ধরেছে ৭৩২ কোটি টাকা। এদিকে ইসি নির্বাচনের ব্যয় বাড়ালেও প্রার্থীদের ব্যয়সীমা একই রেখেছে। ২০১৪ সালের মতোই প্রার্থীর ব্যয়ের সীমা ২৫ লাখ টাকা। তবে ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাস্তবে প্রার্থীরা অনেক বেশি টাকা খরচ করেন। এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য প্রায় ১২ হাজারের কাছাকাছি মনোনয়নপত্র বিক্রি করা হয়েছে যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ফরম কিনতে প্রার্থীদের প্রায় ৩৬ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। জানা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজেলাগুলোতে জাতীয় সংসদের প্রার্থীরা ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ থাকেন, জেলা সদরের প্রার্থীদের খরচ আরও বেশি, আর মহানগর এবং ঢাকা শহরের প্রার্থীদের কোন কোন ক্ষেত্রে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানা যায়, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৭ কোটি ৬২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০১ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ২৯ কোটি ৪১ হাজার টাকা। অথচ ওই নির্বাচনের কয়েক মাস পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় যেখানে ছিল ১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ১৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ৪২ কোটি ৮ লাখ টাকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৬৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ৯৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেটে সরকার ১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন বলে জানা যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৯৫৩ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালের বরাদ্দ পূর্বের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। মনে করা হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই এ বছর বাজেট বরাদ্দ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। জানা যায়, একাদশ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন দিয়েছে। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এবার ২ শতাধিক ব্যবসায়ী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছেন। ফলে ব্যাপক টাকার প্রবাহ বেড়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে যানবাহন, প্রিন্টিং, আপ্যায়ন, মাইকিং, সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। তাই নির্বাচনে গ্রামীণ অর্থনীতি হয় চাঙ্গা। বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম এবং টাকার প্রবাহের ফলে গ্রামীণ দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় বাড়ছে। জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর ফলে টাকার প্রবাহের গতি বাড়তে পারে। ইতোমধ্যেই ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে শহর ও গ্রামের অনাচে কানাচে। চায়ের দোকান, মুদি দোকান, বিলাসবহুল শপিংমল, হোটেল, রেস্তরাঁয় চলছে নির্বাচনী আড্ডা ও প্রচার-প্রচারণা যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
×