ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

চলে গেলেন চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বয়স আশি পেরুলেও শিল্পের টানে সর্বদা সচল ছিল তার রং-তুলির আঁচড়। সৃজনের বিভোরতা দমাতে পারেনি অশীতিপর বরেণ্য চিত্রকরের ছবি আঁকার নেশা। এভাবে সর্বদাই তার জীবনের সঙ্গী হয়েছে সাদা ক্যানভাস। সেই চিত্রপটে রং আর রেখায় মেলে ধরেছেন এদেশের গ্রামগঞ্জসহ মাটি ও মানুষের জীবনকে। চিত্রকর্ম চিত্রনের পাশাপাশি শিল্পের প্রতি প্রবল অনুরাগী শিল্পী বয়স বা অসুস্থকে উপেক্ষা করে হাজির হতেন যে কোন শিল্পায়োজনে। সেই সুবাদে গত ১০ ডিসেম্বর উপস্থিত হয়েছিলেন চারুকলা অনুষদের ৭০ বছর পূর্তির আয়োজনে। সে আয়োজনে শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের সম্মাননা গ্রহণ করে প্রাণোচ্ছল শিল্পী বলেছিলেন, চারুকলার ছাত্রজীবন শেষে করে ১৯৫৮ সাল থেকে শুধু ছবি এঁকেই কাটিয়ে দিলাম পুরোটা জীবন। শনিবার শেষ হলো শিল্পীর সেই শিল্পিত জীবন। প্রিয় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে অদেখার ভুবনে পাড়ি জমালেন একুশে পদকজয়ী দেশের অগ্রগণ্য চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে তার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বিপতœীক ও নিঃসন্তান শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর রেখে গেছেন অসংখ্যক ভক্ত-অনুরাগী ও শুভাকাক্সক্ষী। কয়েক বছর আগে স্ত্রী আনিস জাহাঙ্গীরকে হারানো শিল্পী জাহাঙ্গীরের সংসারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রয়াত বড় ভাইয়ের সন্তানরা। পিতৃহারা ওই সন্তানদের গড়ে তোলাসহ প্রধান অভিভাবকের দায়িত্বটি পরম মমতায় পালন করেছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটির মৃত্যুর খবরে শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে বিষণœ শোকের ছায়া। শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেকেই ছুটে গেছেন তার বাসভবনে। শিল্পীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের মৃত্যু প্রসঙ্গে তার নাতি শেখ শাবাব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় এক গ্লাস পানি পান করতে চান। এরপরই ঢলে পড়েন বিছানায়। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধসহ শরীরের সকল অংশ নিথর হয়েছে। এ অবস্থায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে বেলা ১১টার দিকে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। বিকেলে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার প্রিয় প্রাঙ্গণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্নেহধন্য চারুকলার তৃতীয় ব্যাচের এই চারুশিক্ষার্থী ও পরবর্তীতে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া শিল্পীকে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শোকাচ্ছন্ন শিল্পীসমাজ। বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বাদ জোহর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে তার বাসভবন সংলগ্ন মসজিদে শিল্পীর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাবিতে জানাজা শেষে শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার মোহাম্মদপুরের বাসায়। সেখান থেকে সন্ধ্যায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার জন্মভূমি সাতক্ষীরার তালা থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে। আজ রবিবার সেখানে বাদ ফজর তৃতীয় দফা জানাজা শেষে পারবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হবে বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীকে। আগামী শুক্রবার বাদ আসর শিল্পীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে পরিবারের পক্ষ থেকে তার মোহাম্মদপুরের বাসায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় চারুকলা অনুষদের প্রবেশপথের করিডোরে নিয়ে আসা হয় শিল্পীর মরদেহ। এখানেই তার প্রতি ফুল দিয়ে ভালবাসা অর্পণ করেন শিল্পীসমাজ। সাদা কফিনে মোড়া শিল্পীর মরদেহে ছড়িয়ে দেয়া হয় লাল গোলাপের পাপড়ি। এরপর প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পীসহ সংস্কৃতি ভুবনের ব্যক্তিবর্গ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে নিবেদন করেন পুষ্পাঞ্জলি। ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, রফিকুন নবী, আবুল বারক্্ আলভী, ফরিদা জামান, শহীদ কবির, মনিরুল ইসলাম, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, অভিনয়শিল্পী শংকর সাঁওজাল প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় চারুকলা অনুষদের পক্ষে ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনসহ অন্য শিক্ষকবৃন্দ, শিল্পকলার একাডেমির পক্ষে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষে সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ ও তারিক সুজাত, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষে মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ও চারুশিল্পী সংসদের পক্ষে কামাল পাশা চৌধুরী। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে বেদনার্ত অভিব্যক্তি ধরা দেয় আরেক বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর মুখাবয়বে। শোকাহত কণ্ঠে এই শিল্পী বলেন, চলনে-বলনে, কথাবার্তা কিংবা জ্ঞানের বিচারে সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন আধুনিকতম শিল্পীদের একজন। বয়সে আমি ছোট হলেও আমাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। শিল্পকলা নিয়ে আমাদের তুমুল আড্ডা হতো। আর বয়সকে তোয়াক্কা না করে প্রবল কর্মক্ষম এই শিল্পী সর্বক্ষণ ডুবে থাকতেন কাজের ভেতর। অসুস্থ শরীর নিয়ে মৃত্যুর আগের দিন শুক্রবারও ছবি এঁকেছেন। একটি ছবি আঁকা শেষ হলেই বাসায় ডেকে পাঠাতেন। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলতেন, দেখে যাও একটা নতুন ছবি এঁকেছি। পারিবারিক পরিম-লের কারণেই তার শিল্পচর্চা হয়েছে আরও বেশি স্রোতস্বিনী। তার বড় ভাই ছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর। পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির নির্যাস। তার নিজস্ব শিল্পচর্চার জগত ছিল। শিল্পচর্চার শুরুতে তিনি বিমূর্ত ধারার ছবি আঁকতেন। পরবর্তীতে ক্রমশ ক্যানভাসে জায়গা করে নেয় এদেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি ও গ্রামগঞ্জ। দেশের প্রতি ভালবাসা থেকেই মূলত তিনি বিমূর্ত ধারা থেকে সরিয়ে ক্যানভাসে মূর্ত করেছিলেন স্বদেশের রূপ। একজন সফল শিল্পীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন অনেক বড় শিল্প উদ্যোক্তা। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগ। ওই পরিচালকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনিই এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের প্রবর্তন করেন। এই দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের শিল্পরসিকদের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত। রফিকুন আরও বলেন, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন চারুকলা অনুষদের তৃতীয় ব্যাচের কৃতী ছাত্র। জয়নুল আবেদিনের খুব স্নেহধন্য ছিলেন। তাদের সেই বন্ধনের কারণেই হয়ত ২৯ ডিসেম্বর জয়নুল আবেদিনের জন্মদিনে প্রস্থান হলো সৈয়দ জাহাঙ্গীরের। অনেক গুণে গুণান্বিত এই শিল্পী ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে ইসলামাবাদ থেকে বেতারে বাংলা খবরও পাঠ করতেন। আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম তার সংবাদপাঠ। এমন মানুষের মৃত্যুতে আমরা চারুকলা পরিবার অনেক বড় একজন শুভানুধ্যায়ীকে হারালাম । অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন এদেশের চিত্রশিল্পের পুরোধাস্বরূপ। চিত্রকলার ভুবনে তিনি খুবই সক্রিয় জীবন-যাপন করেছেন। তার এই মৃত্যুতে আমরা ভীষণভাবে শোকাহত। রামেন্দু মজুমদার বলেন, পাকিস্তান আমল থেকেই এদেশের শিল্পচর্চার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। শুধু ছবি আঁকার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি কাজ করেছেন এদেশের সামগ্রিক শিল্প-সংস্কৃতির কল্যাণে। শিল্পী হিসেবেও রেখে গেছেন স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর। আঁকার ধরনের কারণে তার ছবি দেখলেই সহজে চেনা যেত। পঞ্চাশের দশকে যেসব শিল্পীর আবির্ভাব বাংলাদেশের চিত্রকলার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিল, সৈয়দ জাহাঙ্গীর তাদের অন্যতম। ১৯৫৫ সালে তিনি তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এর পরপরই তার কাজে সমকালীন মার্কিন চিত্রকলার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যা বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে তৃপ্তিকর বৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে। তিনি বহু মাধ্যমে কাজ করেছেন, তবে তেলরঙের প্রতি ছিল তার পক্ষপাত। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা প্রকাশ করা সত্ত্বেও তার ঝোঁক ছিল বিমূর্ত রীতির ছবির দিকে। রং ও আকার, জমিন ও আলোর নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত-অবস্থান নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন তার ছবি। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে জন্ম নেয়া সৈয়দ জাহাঙ্গীর বড় হয়েছেন শহরে। কিন্তু তার চিত্রকর্মে তিনি বারবার তুলে ধরেছেন তার গ্রাম ও প্রকৃতিকে। নানা চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে করা কাজ ‘আত্মার উজ্জীবন’ উল্লেখযোগ্য। প্রায় ২২ বছর পেশাদার চিত্রকর হিসেবে কাজ করার পরে তিনি ১৯৭৭ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তার হাত ধরেই শিল্পকলা একাডেমিতে চালু হয় চারুকলা বিভাগ। শিল্পকলায় কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি দ্বিবার্ষিক এশিয়া চারুকলা প্রদর্শনীর প্রবর্তন করেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৮৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৯২ সালে চারুশিল্পী সংসদ তাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শশীভূষণ সম্মাননা, বার্জার পেইন্টস আজীবন সম্মাননা, হামিদুর রহমান পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের শিল্পকর্ম ঠাঁই পেয়েছেন শিল্পকলায় একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ বিমান, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের প্রধান শাখায় রয়েছে তার বিশালাকার একটি ম্যুরাল।
×