ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ অভিযোগ বিএনপি-জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে

ভোটের মাঠে কোটি কোটি কালো টাকার ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

ভোটের মাঠে কোটি কোটি কালো টাকার ছড়াছড়ি

রহিম শেখ ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অসৎ উদ্দেশে ইতোমধ্যে দেশে দেড় থেকে দুইশ কোটি টাকা ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোটের মাঠে বড় অঙ্কের এই অর্থ ছড়ানোর অধিকাংশ অভিযোগ উঠেছে বিএনপি-জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগেই অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। নির্বাচনে কোনভাবেই যেন কালো টাকার লেনদেন না হয়, সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ভোটের মাঠে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যাতে অর্থ লেনদেন না হয় সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সেবাটি সাময়িক বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টানা ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সেবাটি সচল হবে আজ বিকেল ৫টায়। এছাড়া নির্বাচনী ভোটে যাতে প্রার্থীরা কালো টাকা ছড়াতে না পারেন সে লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) বিশেষ নজরদারি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের নির্বাচন অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। সব দলের প্রার্থীই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে প্রার্থীরা এ বছর বেশি পরিমাণে অর্থ ব্যয় করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নির্দেশিত একেক প্রার্থী ২৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে পারবেন না। খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচনের কারণে এ বছর কালো টাকার বিস্তার বাড়বে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অন্যান্য তসফিলি ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য তার এ নির্দেশনার পর ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন এমপি প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। আজ সারাদেশে ২৯৯ আসনে নির্বাচন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদসহ অন্য জোট প্রার্থী দিয়েছে এসব আসনে। সারাদেশে ১ হাজার ৮০৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২৫ লাখ টাকা খরচ করলে নির্দেশিত ব্যয় দাঁড়াবে অন্তত সাড়ে চারশ কোটি টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে কোনভাবেই যেন কালো টাকার লেনদেন না হয়, সে ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে কমিশন। তিনি জানান, ভোটের মাঠে যে কোন দলের, যে কোন প্রার্থী বা তাদের কর্মী-সমর্থক অর্থের বিনিময়ে ভোট কিনবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে ভোটারদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সংবাদপত্র ও টিভিতে প্রচার বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অসৎ উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে দেশে প্রায় দেড় থেকে দুইশ কোটি টাকা ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ পর্যন্ত ভোটের মাঠে এসব টাকা ছড়ানোর অধিকাংশ অভিযোগ পাওয়া গেছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে রাজধানীর মতিঝিলের সিটি সেন্টারে নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করার জন্য নগদ ৮ কোটি টাকা ও ১০ কোটি টাকার চেক উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ওই সময় আটক করা হয় তিনজনকে। যারা বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাংক হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছেন। ওই ভবনে অবস্থিত ইউনাইটেড কর্পোরেশন, ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ ও আমেনা এন্টারপ্রাইজের কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অর্থ পাঠানোর তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ (বিএফআইউ)। বিএফআইউর তথ্য মতে, গত এক মাসে অন্তত ১৫০ কোটি টাক লেনদেন করেছে প্রতিষ্ঠান তিনটি। এর মধ্যে শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মিয়া নূরুদ্দীন অপুর ব্যাংক হিসাবে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। এই নূরুদ্দীন অপু একসময় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। গত মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলের সিটি সেন্টারে এসব টাকা উদ্ধার করে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, টাকাগুলো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভোট কেনার জন্য দুবাই থেকে বাংলাদেশের পাঠানো হয়েছে। টাকাগুলোর অধিকাংশই দুবাই থেকে হুন্ডি ও ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, ভোট কেনার জন্য টাকাগুলো রাখা হয়েছিল। যারা কালো টাকা দিয়ে ভোট কিনে, তারা ক্ষমতায় এলে দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে তিনি জানান। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারের সময় নগদ টাকা দিয়ে ভোট কেনার সময় বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা আব্বাসের দুই কর্মীকে আটক করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, ভোটারদের প্রলুব্ধ করতে এই টাকা বিতরণ করছিলেন এই দুই জন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, আটক হওয়া দুই জন নির্বাচন উপলক্ষে মালয়েশিয়া থেকে এই টাকা নিয়ে এসেছেন। এছাড়া লিফলেটের সঙ্গে টাকা বিতরণের মাধ্যমে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ পৌর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ আহমেদকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নবীগঞ্জে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতাউল গণি ওসমানী তাকে এ সাজা দেন। অন্যদিকে গত ২৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধা সদর উপজেলার ফজলুপুরের কাউয়াবাধা চর এলাকা থেকে ধানের শীষের পক্ষে টাকা ছড়ানোর সময় নগদ টাকাসহ জামায়াতের ৭ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, টাকা বিতরণের সময় হাতেনাতে ধরার পর তাদের গাইবান্ধা সদর থানায় নেয়া হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের প্রত্যেককে ১৫ দিন করে কারাদন্ড দেয়া হয়। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে টাকার মালা পরিয়ে বরণ করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতে। গত ২৩ ডিসেম্বর সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নে শিবগঞ্জ সিনিয়র দাখিল মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত জনসভায় ঠাকুরগাঁও-১ আসনে ধানের শীষ প্রার্থী মির্জা ফখরুলের গলায় টাকার মালা পরিয়ে দেন স্থানীয় সমর্থকরা। ১০০ ও ৫০০ টাকার মোট ১০টি মালা পরানো হয় তাকে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর রহমান জানান, দলের স্থানীয় সমর্থকরা খুশি হয়ে নির্বাচনের প্রচারে সহায়তার জন্য মির্জা ফখরুলের গলায় টাকার মালা পরিয়ে দেয়। এর আগে ২০০১ সালেও একটি অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুলকে টাকার মালা পরানো হয়েছিল। এদিকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াতে একটি গ্রুপ অপপ্রচারকারীদের ৪৭ টাকা অর্থায়ন করেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ অপরাধে গত শুক্রবার রাতে ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই ৮ জন গুজবের বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারের কাজ করতো বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অপপ্রচারকারীরা নির্বাচন ঘিরে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। প্রজেক্টের আওতায় অন্তত ১৫০টি ওয়েবসাইট তৈরি করবে তারা। এরপর বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে সেসব সাইট, ফেসবুক ও পেজে প্রচার করার উদ্দেশ্য ছিল তাদের। এসব কাজের জন্য একটি গ্রুপ থেকে ৪৭ লাখ টাকার অর্থায়ন পেয়েছে ওই গোষ্ঠী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে নিয়মের ব্যারিকেড ভেঙ্গে প্রার্থীরা ব্যয় করে থাকেন। প্রতিটি আসনে গড়ে ৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। সবাই মিলে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করবেন। আর ঢাকার আসনগুলোয় তো একেক আসনেই ২ থেকে ৪ কোটি টাকা খরচ করবেন একেক প্রার্থী। সে হিসাবে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা ব্যবহার হতে পারে এবারের নির্বাচনে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে কালোটাকার প্রভাবমুক্ত করতে প্রশাসনের নজরদারি দরকার। নজরদারির মাধ্যমেই এটি রোধ করা সম্ভব। তবে নজরদারির নামে যেন হয়রানি করা না হয় সেদিকে নজর রাখা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ভোট কেনাবেচা বড় অপরাধ। এটি বন্ধে কঠোর মনিটরিং করা প্রয়োজন এবং ভোটারদের এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা উচিত। ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ॥ গত শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে ভোটগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত বৃহস্পতিবার। টানা ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সেবাটি সচল হচ্ছে আজ বিকেল ৫টায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ভোট সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এই ‘নির্দিষ্ট’ সময়ের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়।
×