ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ হাসিনার পক্ষেই শিক্ষকদের অবস্থান

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

শেখ হাসিনার পক্ষেই শিক্ষকদের অবস্থান

আজ একাদশ সংসদ নির্বাচন। নানা বিতর্ক, বিভিন্নজনের বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থান, রাজনৈতিক ও দলীয় পালাবদল, ক্ষেত্র বিশেষে নেতৃত্বের কোন কোন অংশের অর্ধ শতকের বিপরীতে ভূমিকা গ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দানব শক্তির সঙ্গে গালাগালির বদলে গলাগলি, চিহ্নিত শত্রুর সঙ্গে মিত্রের অধিক সৌহার্দ্য, দৃষ্টিকটু মৈত্রী, অবিশ্বাস ও সংশয়ের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে অনেকের অনেক সমীকরণ ও হিসাব নিকাশ বদলে দিয়ে এ নির্বাচনে অর্জিত হতে পারে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও অপরিমেয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। এক্ষেত্রে সমাজে কার কি অবস্থান, তার নিরাসক্ত মূল্যায়ন প্রয়োজন। যে শিক্ষকদের সঙ্গে আমার সারা জীবনের ওঠাবসা, দুর্দিনে দুঃসময়ে এক সঙ্গে পথচলা- এ নির্বাচনে তারাই বা কি ভাবছেন? আজকের লেখাটি এ নিয়েই। বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায় স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে অতীতও। শিক্ষকদের পেশাগত সংগঠনও বিভাজনের উর্ধে নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী সংগঠনগুলো প্রত্যেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২৩ ডিসেম্বর শহীদ মিনারের পেশাজীবী সমাবেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির অনুকূলে সমর্থন ব্যক্ত করে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, মানবতার শত্রু জামায়াতে ইসলামী, আলবদর, আলশামস, গণশত্রু রাজাকারদের রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করা হিমালয় সমান গর্হিত অপরাধ হয়েছে। এর কার্যকর প্রতিকারের সময় এসেছে। না হলে প্রজন্মাত্তরে প্রায়শ্চিত্ত করেও কূল পাওয়া যাবে না। শিক্ষক কর্মচারী সংগ্রাম কমিটি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে, কর্মসূচী দিয়ে নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমর্থনে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তাদের বক্তব্যে এসেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, আইসিটি শিক্ষা প্রচলন ও ৭০০০ আইসিটি শিক্ষককে এমপিওভুক্তকরণ, ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ, ২ হাজার ৬১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তকরণ, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান, ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, মেট্রোরেল স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, পায়রা সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠাসহ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। দেশের এই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। শিক্ষক নেতৃত্বের এ অংশ শিক্ষকদের ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষকের সমর্থনপুষ্ট হলেও এর বিপক্ষে শিক্ষক নেতৃত্বের একটি অংশ থাকলেও তারা ক্ষীণ শক্তির অধিকারী এবং হীনবল। এদের মধ্যে অনেকেই আবার শেখ হাসিনার সমর্থক অর্থাৎ তার হাত দিয়ে শিক্ষকদের কল্যাণে যে সব অর্জন হয়েছে তাকে স্বীকার করেন। যেমন হয়েছিল ২০০১ থেকে ২০০৮ সালে। তখনকার একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের হাতে কয়েক হাজার শিক্ষকের চাকরিচ্যুতি, শিক্ষা ও শিক্ষক পরিপন্থী ৯টি কালাকানুন জারি, লাগামহীন দুর্নীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার নগ্ন দলীয়করণ, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে এমনকি ঢাকা মহানগরীতে নেতার বদলে যুবকর্মীকে মনোনয়ন প্রদান, নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণ না করা এমনকি বার বার সরকারপ্রধান খালেদা জিয়ার সাক্ষাতকার চেয়েও না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের বেসরকারী স্কুল-কলেজ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের ১১টি সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম, জাতীয় শিক্ষক- কর্মচারী ফ্রন্ট যে আন্দোলন গড়ে তুলে আক্ষরিক অর্থেই তা ছিল ঐতিহাসিক। জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো ও আইএলও শিক্ষক-কর্মচারী নির্যাতনের প্রতিবিধানে সরকারের কাছে লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এক পর্যায়ে ওই দুটি বিশ্ব সংগঠনের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আনীত অভিযোগ সমূহ শুনানির জন্য হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্মত হন। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ মুহূর্তে অপারগতা প্রকাশ করেন। এমতাবস্থায় কে কোন্ দলের অনুসারী তা ভুলে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের ব্যানারে দেশব্যাপী এমন আন্দোলনের সূচনা করে যা শুধু জাতীয় মিডিয়ার নয়, বিশ্ব মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর মধ্যে কয়েকটি কর্মসূচী উল্লেখযোগ্য। সরকারের কাছে দাবির সপক্ষে এই প্রথম বাংলাদেশে নিজেদের রক্তে স্মারকলিপি লিখে শিক্ষকরা এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে শিক্ষকদের অবস্থান সংক্রান্ত উল্লিখিত মূল্যায়নের সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শিক্ষা উন্নয়নে, মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রত্যাশাগুলো তুলে ধরা না হলে লেখাটি অসম্পূর্ণ হবে বলে মনে করি। শিক্ষানীতি ২০১০-এ যে সব বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোর মূল্যায়ন এবং যেগুলোর বাস্তবায়ন বাস্তবায়ন হয়নি- যেমন : স্থায়ী শিক্ষা কমিশন, পিএসসির আদলে শিক্ষক নিয়োগ কমিশন, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের জন্য প্রচলিত বেতন কাঠামোর উর্ধে ‘স্বতন্ত্র বেতন স্কেল’ কার্যকর করা যাতে করে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয়- এসব বিষয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচিত নতুন সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় থাকবে বলে শিক্ষকরা প্রত্যাশা করেন। একই সঙ্গে আমি মনে করি, শিক্ষায় বাণিজ্যিকীরণ বন্ধ না করতে পারলে শিক্ষার মানের পরিবর্তন ঘটবে না। একই সঙ্গে শিক্ষাকে টেকসই করতে হলে শিল্প বাণিজ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকমানের হিসেবে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী- আগামী ১০ বছরে কতজন প্রকৌশলী লাগবে, কতজন মেকানিক প্রয়োজন হবে, কতজন চিকিৎসক লাগবে- সে পরিকল্পনা করতে হবে। জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে এ নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়। আমরা জানি শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নীত করার বিষয়টি কার্যকর করা যায়নি। শিক্ষানীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এখন জেন্ডার সমতার যুগ। ছেলেদের জন্য আলাদা ‘স্কুল’ আর মেয়েদের জন্য আলাদা ‘স্কুল’ এটা করা আর ঠিক হবে না। আল্টিমেটলি শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ইনকুলুসিভ এডুকেশন’ নিশ্চিত করতে হবে। এখন মূল ধারায় আনতে হবে। সাধারণ ছেলেমেয়ে এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের একই স্কুলে পড়াশোনা করতে হবে। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়নে প্রচলিত পরীক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কার করতে হবে। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের ফলে সৃষ্ট দক্ষ শিক্ষকের স্বল্পতা নিরসনে এলাকাভিত্তিক শিক্ষক বিনিময় ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউনেস্কো ঘোষিত ও প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষকনীতি প্রণয়ন ও শিক্ষক-অভিভাবকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে স্কুল লিডারশিপ কার্যক্রম বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমি আশাবাদী ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন নতুন সাফল্য অর্জন করবে। তার ভিত্তি হবে যুগোপযোগী, জীবনমুখী শিক্ষা, যেখানে শিক্ষার্থীর জন্য অবারিত হবে অনুকূল সকল সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষক হবেন মানবিক ও দক্ষ এবং শিক্ষকের মর্যাদা হবে বিশ্ব মানের। আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এসব প্রত্যাশা পূরণে ২০১৮ সংসদ নির্বাচন সার্বিক বিবেচনায় অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হবে। লেখক : শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা [email protected]
×