ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

বাংলাদেশ বাংলাদেশই থাকবে

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ বাংলাদেশই থাকবে

বিতর্কিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তাঁর ফেসবুকে তরুণ ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছেন, ‘এই সময়ে এটাই সুযোগ। আমাদের বাংলাদেশ কি ধরনের বাংলাদেশ হবে তা নির্ণয় করার’। এর মানে কি? এর মানে খুবই পরিষ্কার যেÑ যাদের মন-মগজে বাংলাদেশের ধরন ও অগ্রগতি নিয়ে সন্দেহ, দেশটা না জানি হাতছাড়া হয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে তা যতই বাংলাদেশ সঠিকপথে যাক না কেন, এটা তারা মন থেকে মানতে নারাজ আর সেই সন্দেহ তরুণ সমাজের মনে কায়দা করে ঢুকিয়ে দেয়া যে বাংলাদেশ এখন সঠিকপথে চলছে না। না হয় ‘এটাই সুযোগ, বাংলাদেশ কি ধরনের বাংলাদেশ হবে তা নির্ণয় করার’Ñ এসব কথার অর্থ কি আমাদের তরুণ সমাজ বুঝে না? বাংলাদেশ যে পথে যাচ্ছে আর যাবে বা যাওয়া উচিত সেটা তো ১৯৭১ সালেই নির্ণীত হয়ে আছে। এখন সবাই মিলে যে দেশটা শক্ত হাতে এগিয়ে নিতে হবে শহিদুল আলমরা সে কথা বলবেন কেন? এ রকম সন্দেহবাতিক ও বাংলাদেশ নিয়ে বিকারগ্রস্ত চিন্তার মানুষ দেশে এখনও আছে, এটাই উদ্বেগের বিষয়। আগস্ট মাসে সড়ক আন্দোলনের একপর্যায়ে আল জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাতকারে শহিদুল আলম বর্তমান সরকার ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন যেন সেসব কথা শুনে সারা দুনিয়ার মানুষ বিভ্রান্ত হয়। ফলে কিছুদিন তাঁকে সংশোধনাগারে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। জামিনে মুক্তি পেয়ে নানারকম বিরক্তি ছড়িয়ে তিনি দেশের ও বিদেশের মানুষকে বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করতে তৎপর আছেন। উপরের উদাহরণ এর জ্বলন্ত প্রমাণ। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ সঠিক পথেই যাচ্ছে। উন্নয়নের নানারকম সূচক নিয়ে দশ বছরের তুলনা দেখলে এটা সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশ কোন একটি বিতর্কের বিন্দুতে থেমে নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ প্রশমন, মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের অনেক সফল পথ বাংলাদেশ এই এক দশকে পার করেছে। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে বাংলাদেশের ইতিহাস ঘুরিয়ে দেবার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশ সেখান থেকে অবশ্যই ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ৪৩ বছরের জঞ্জাল অপসারণে এক দশক যথেষ্ট নয়Ñ এটাও বাংলাদেশের মানুষ এখন বুঝে। মাঝখানে ’৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর একবার ইতিহাস ঠিক করার সুযোগ পেয়েছিল এদেশের মানুষ তখন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারটা অন্তত শুরু করতে পেরেছিল। যারা এখন বড় বড় উপদেশ দেন তাঁদের একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দিকেই দৃষ্টি দেয়া দরকার যে, আমরা এমন এক দেশের উপযাচক উপদেশক নাগরিক বলে দাবিদার যে দেশের জাতির জনক, রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতাকে সপরিবারে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে আর সে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা যাবে না এমন আইন করা হয়েছে, তখন নিজের চেহারাটা দেখতে কেমন দেখায়? তা হলে তো আজ যে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে, তখন দেশটা কোথায় যাচ্ছিল? সেটা কি তখন নির্ণীত হয়েছিল? যদি কেউ পেছনে ফিরে ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে এই প্রশ্নই করেÑআমি কেমন মানুষ, যারা কিনা আমাদের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে আমরা তাদের প্রকাশ্যে বাহাদুরি করতে দেখেছি, রাজনীতি করতে দেখেছি আর বুক ফুলিয়ে বলতে শুনেছি, আমরাই হত্যা করেছি আমাদের কেউ কিছু করতে পারবে না! তখন কি বাংলাদেশ সঠিকপথে চলছিল? তখন কি আমি বলেছি আমাদের কার কি দায়িত্ব? কী সুযোগ আমাদের সামনে ছিল? আয়নায় নিজেকে কেমন দেখায় যখন কেউ সামনে দাঁড়ায় আর মনে পড়ে আমার দেশের স্বাধীনতায় যারা আপত্তি করেছে, আমাদের বাবাকে মেরেছে ও আমার মা-বোনকে পৈশাচিক অত্যাচার করেছে, আমি তাদের দেখেছি তারা আমাদের দেশের মন্ত্রী হয়েছে! আমি কি তখন বাংলাদেশ সঠিকপথে যাচ্ছে কি-না তা বলেছি? আমি কি তখন এই অবিচার থেকে মুক্ত হতে কাউকে সুযোগ খুঁজে নিতে পরামর্শ দিয়েছি? যে দেশের বুকের ওপর পাথরের মতো এসব অপমান, কলঙ্ক আর যন্ত্রণা বোঝা হয়েছিল বছরের পর বছর, তখন আমাদের আজকের এ রকম খ্যাতিমান উপদেশকগণ তরুণদের ডেকে বলেননি, এটাই সুযোগ, এই দেশ কোথায় যাবে তা এখন ঠিক করতে হবে। তাই সময় লেগেছে অনেক। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ফলে দেশ কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে বলতে পারছে আমাদের উন্নত শির, আমরা অন্যায় মেনে নিয়ে মুখ বুঝে বসে থাকি না। কারণ, আমরা বীরের জাতি। সেই বীরের জাতির যে দেশ সে দেশ কলঙ্কমুক্ত থাকলে এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। রাহুমুক্ত হলে দেশ উন্নতির শিখরে যেতে থাকবে এটা কারও কারও সহ্য হবে কেন? যদি কারও মাথায় থাকে ঘুণপোকার বসতি সে কোথায় খুঁজে পাবে বাংলাদেশ, সে বুঝবে কেমন করে সোনার বাংলাকে ভালবাসার প্রশান্তি কেমন। এরা কখনই বুঝবে না। কারণ, এদের তথাকথিত খ্যাতির মধ্যে জ্ঞানের বিড়ম্বনা আছে। যা এই দেশের সঙ্গে যায় না। এরা প্রতিনিধিত্ব করে ফ্যাশন বাংলার উঁচু আশরাফ সমাজ। আশরাফের মর্যাদা বোঝার ক্ষমতাই এদের নেই, সেই চোখও নেই। ইতিহাস জ্ঞান আছে এমন ও সামান্য বিবেকবান যে কোন মানুষ বুঝবেন যে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি ও আবেগের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে হলেও যদি কেউ খুঁজে পেতে দেখেন যা এখনও হাতের কাছে পাওয়া যায়। দেখবেন ’৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে উচ্চবিত্তের শিক্ষার বাজার নির্মাণ ও ’৬৮ সালের তথাকথিত ‘দেশ ও কৃষ্টি’ অপনির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সবই ছিল বাঙালীর আবেগমথিত। সে তাঁর সংস্কৃতির সামান্য অবমূল্যায়ন কখনই মেনে নেয়নি। ফলে বাংলাদেশের সকল আন্দোলন সংস্কৃতি-চেতনা থেকে উৎসারিত যা একই সঙ্গে সামাজিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে তাকে একপর্যায়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। সে যুদ্ধ বাঙালীকে জয়ী করেছে। যারা বাঙালীর এই সংস্কৃতি, সংস্কৃতির আবেগ বুঝতে অক্ষম তারা চিরকাল এদেশের মানুষকে জুজুর ভয় দেখাতেই থাকবেÑ ‘দেশটা ভাল চলছে না’, ‘সঠিকপথে চলছে না’ ইত্যাদি কথা বলবে বটে কিন্তু আসল কথাটি বলবে না যে, আসুন সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান রক্ষা করতে ভোট দেই, সবাই মিলে আমাদের সংস্কৃতির আবেগের মর্যাদা রাখতে ভোট দেই, আসুন সবাই মিলে দেশটা যে অনেক কষ্টে সঠিকপথে আনা হয়েছে তা ধরে রাখতে ভোট দেই। এরা প্রকারান্তরে ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলবে তা বলার কোন মূল্য নেই, কোন প্রয়োজনও নেই। তাই এবারের ভোটে আমাদের সকলের উচিত হবে প্রকাশ্য করে বলা আমি কাকে ভোট দেব- আমি তাঁকেই ভোট দেব যে আমার মাথা উঁচু রাখবে। যে অন্যায় প্রশ্রয় দিয়ে আমাদের ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিতে চেয়ে আমাকে সারা দুনিয়ার কাছে দিনের পর দিন লজ্জিত করে রেখেছে তাকে আমি কিছুতেই ভোট দেব না। আমি তাঁকেই ভোট দেব, যে আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে দিবারাত্র চেষ্টা করছে, আমরা ভোট দিয়ে তাঁদের হাতকেই শক্তিশালী করব। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ, আমার ভয় কিসের? আমি ভোট দেব যে বঙ্গবন্ধুকে মর্যাদা দেয়। আমি তাঁকে ভোট দেব যে বাংলাদেশের ইতিহাস জানে ও মানে। যে বাংলাদেশের সম্মান বুঝে ও বিদেশের কাছে মিথ্যা বলে আমার মাথা নিচু করে না। আমি তাঁকেই ভোট দেব যে এদেশের মানুষকে দুই বেলা খেতে দিতে ভাবে ও নিরন্নের পাশে দাঁড়ায়। আমি কেন তাঁকে ভোট দেব যে আমাকে সম্মান করে না? তাই ওইসব ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা কথা না শুনে আমি আমার নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাইÑ আমি কাকে ভোট দেব। আমার ভোট আমি অবশ্যই দেব কিন্তু যাকে খুশি তাকে নয়, ভোট দেব যে আমার ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে চলে তাঁকে, ভোট তাঁকেই দেব যে আমার স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে চলে, আমার দেশকে ভালবাসে। ভোট দেব তাঁকে যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাকেও সঙ্গে নেবে, আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে মাথা উঁচু করে দুনিয়াকে দেখিয়ে বলবে, আমরা সেই বাঙালী জাতি! আর আমি বলব, আমার দেশ বাংলাদেশ, ভোট দিয়ে সেই দেশ আমি আমার বুকের কাছেই রাখব। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×