ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে এক নতুন মুখ ও কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 চট্টগ্রামে এক নতুন মুখ ও কিছু স্মৃতি

চট্টগ্রাম তথা দেশের অবিসংবাদিত বরেণ্য ও নন্দিত নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনার পরীক্ষিত নির্ভীক রাজনীতিক, চট্টলবীর প্রয়াত আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র ব্যারিস্টার নওফেল আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম ৯ আসনে জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া বিশ্বের মহীয়সী নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এ মাসের ৩০ তারিখ ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন। তারুণ্যের অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ ও মেধা-প্রজ্ঞার অনবদ্য প্রতীক ব্যারিস্টার নওফেলের শুভ কামনায় এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের উপস্থাপন। ১৯৮১ সালে জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা দলের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়েরও জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। শুধু মেয়র নির্বাচনে জয়যুক্ত হওয়াই নয়, জাতির জনকের আদর্শিক চেতনায় শাণিত এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা এবং পরামর্শে কঠিন সময়ে সাংগঠনিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দলকে করেছেন সুসংগঠিত-সুসংহত। তিন তিনবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে চট্টগ্রামের সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য তার সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের উৎকৃষ্ট পরিচায়ক। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আদর্শিক কর্মযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনের আগেই। তখন আমি চট্টগ্রামের লাভলেইন আবেদীন কলোনিতে বসবাস করতাম। আমার বাসার সামনেই ছিল আবেদীন প্রেস। সে প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন মহিউদ্দিন ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি হেনা ইসলাম। সে সুবাদে প্রেসে লিফলেট, পুস্তিকা, সাময়িকীসহ দলের এবং মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে জাতির জনকের সকল ভাষণ-বক্তব্যের নানাবিধ প্রচার ও প্রসারে যে গুরুদায়িত্ব মহিউদ্দিন ভাই নিয়েছিলেন, যার মূল মুদ্রণ কেন্দ্র ছিল আবেদীন প্রেস। সেখানে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিক সম্পর্ক। নির্বাচনের আগে সঠিক দিন-তারিখ স্মরণ না থাকলেও ঢাকার পল্টনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। চার পৃষ্ঠার একটি বুলেটিন ছাপিয়ে দ্রুত তা ঢাকায় নিয়ে সভায় প্রচারের জন্য তখনকার দিনের ১২টায় গ্রীনএ্যারো ট্রেন ধরার জন্য লাভলেইন থেকে দ্রুত হেঁটে দৌড়াচ্ছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। হাতে সময় কম ছিল বলে স্টেশন পর্যন্ত রিক্সা নিতে বললে তিনি বললেন পকেটে কোন টাকা পয়সা নেই। তিনি ট্রেন ধরার জন্য দৌড়াচ্ছেন। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র এবং এসএসসি ফলাফলের জন্য অপেক্ষারত। আমার পকেটে মার কাছ থেকে পাওয়া ১০ টাকা ছিল। সেটা আমি মহিউদ্দিন ভাইকে দিতে চেয়েছিলাম। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাই আমার পিঠে তার হাতের আদরের ছোঁয়া দিয়ে বললেন, আপনার টাকা আমার নেয়া ঠিক হবে না। আমি দৌড়াতে অভ্যস্ত এবং ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছে যাব। প্রেস থেকে বেরিয়ে আমি দেখছিলাম কিভাবে তিনি দৌড়ে যাচ্ছিলেন। মহিউদ্দিন ভাই দৌড়ের শুরুতে তার স্পঞ্জ স্যান্ডেলের বোতাম খুলে গেলেও সময় ছিল না বলে দুটো স্যান্ডেল একসঙ্গে ড্রেনে ফেলে খালি পায়ে দৌড়াতে লাগলেন। অতি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম কী করে একজন মানুষ এত মানসিক শক্তি নিয়ে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রয়াত হওয়ার দিন পর্যন্ত এত বেশি দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞের হৃদয়বিদারক ও মনোবেদনার বিপুল স্মৃতি, যা আমার প্রকাশিতব্য বইয়ে উপস্থাপন করার প্রত্যাশা রয়েছে। ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে মুসলিম হলে হাসপাতাল পরিচালনা, একুশে মেলার আয়োজন, বিজয় মেলা আয়োজন, মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ, মেয়র নির্বাচনের জন্য নাগরিক কমিটি গঠন ও প্রচার অভিযান পরিচালনা, জাপানের কোবে সিটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং সোনার চাবিসহ সংবর্ধনা গ্রহণ, চারবার পবিত্র হজব্রত পালন, ৩০ এপ্রিল ডেটলাইন মোকাবেলা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার সঙ্গে ‘জনসংখ্যা জরিপ’ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মামলার আসামি হওয়া এবং ন্যূনতম কিছু প্রমাণ না পাওয়ার কারণে সে সময়ে দায়মুক্ত হওয়া, নিগৃহীত পরিচ্ছন্ন কর্মী যারা মেথর হিসেবে পরিচিত ছিল তাদের নিয়ে গবেষণা এবং তাদের সেবক নামে মর্যাদাসীন করা, প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন, বন্দর বাঁচাও আন্দোলন এবং এসএসএএর বিরুদ্ধে আদালতে জয়লাভ তথা বন্দর/চট্টগ্রামকে রক্ষা করা, ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মশালাসহ বিপুল সংখ্যক কঠিন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে কাজগুলো করেছিলাম, সবকিছুর পেছনে মূল প্রণোদনা ছিল মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা এবং সাহসী পদক্ষেপ। ২৭ বছর ধরে মহিউদ্দিন ভাই ডিসেম্বরের প্রথমদিন বিজয় মেলা উদ্বোধন করে আসছিলেন। বিগত বছর উনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিজয় মেলা পরিষদের সম্মানিত সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুসকে বললেন আমি যেন তার পরিবর্তে বিজয় মেলা উদ্বোধন করি। মহিউদ্দিন ভাইয়ের অসুস্থতার কারণে তার পরিবর্তে ১ ডিসেম্বর ২০১৭ বিজয় মেলা উদ্বোধন আমার জীবনে অত্যন্ত উঁচুমার্গের অর্জন। নির্দেশ ছিল ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় আমাকে প্রধান অতিথি থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচী শেষে সেদিন দুপুরে তার বাসায় গিয়ে শুনলাম তিনি চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দ্রুততার সঙ্গে সেখানে গিয়ে আইসিইউতে ঢুকে তার রক্তচাপ দ্রুততার সঙ্গে কমে যাওয়ার বিষয়টি অবলোকন করে হাত ধরে বিনীত অনুরোধ করলাম কিছু খাওয়ার জন্য। আমাকে বার বার বলছিলেন খেতে ইচ্ছে করছে না, খেতে পারছেন না। হাত ধরে নিরবে কাঁদছেন এবং গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম চোখের জল। দু’জনের নীরব কান্নাকাটিতে একসময় মহিউদ্দিন ভাইয়ের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকা হাসপাতালের সে দু’জন নার্স তার রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারা আমাকে ইশারা করেছিলেন যেন আমি সরে পড়ি। যেহেতু মহিউদ্দিন ভাই আমার হাত ছাড়ছিলেন না, কেবলই কাঁদছিলেন এবং মাঝে মাঝে হাত তুলে কাঁপা কণ্ঠে বললেন ‘দোয়া করবেন, আপনার দোয়া কাজে লাগবে।’ যখন বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছিল এবং নোঙ্গরের মতো মাটি ভেদ করে উনার হাত থেকে হাত সরিয়ে নিতে হচ্ছিল দু’জনেই দু’জনের চোখাচোখি এবং চোখের জলে বিদায় সেটি ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সম্ভবত চেনা-জানা সকলের মধ্যে আমার সঙ্গেই তার এটি শেষ বাক্য বিনিময়। সেদিন বিকেলে বিজয় মঞ্চে গিয়ে ইউনূসের কাছ থেকে শুনতে পেলাম মহিউদ্দিন ভাইয়ের জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসছে। আমি মঞ্চ ত্যাগের কথা চিন্তা করলে ইউনূস বললেন উনার নির্দেশ ছিল যে কোন পরিস্থিতিতে কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার। ইউনূস কর্মসূচী শুরু করলেন। শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার অনুষ্ঠানে আমাকে কখনও প্রধান অতিথি ও কখনও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। তা ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের নির্দেশে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিতে হতো। মহিউদ্দিন ভাই আামকে এত বেশি ¯েœহ করতেন কী রাজনৈতিক, কী সামাজিক সব অনুষ্ঠানে ফোন করে আদরমাখা দুষ্টুমির সঙ্গে আমন্ত্রণ জানাতেন। যা আমি কখনও অবজ্ঞা বা ‘না’ করতে পারতাম না। মহিউদ্দিন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আমি ফুলের তোড়া নিয়ে সেখানে উপস্থিত হই। স্কয়ার হাসপাতালে কাউকে ফুলের তোড়া নিয়ে ঢুকতে দেয়া হয় না। আমি বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চমৎকার একটি ফুলের তোড়া নিয়ে উনার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি তখন ঘুমের ঘোরে ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলতেই আমাকে দেখে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘ও হুজুর অনে কত্তে আইস্যুন’ এবং ফুলের তোড়া দেখে এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন এবং মেয়েকে চিৎকার করে বললেন ছবি নিতে। আমার ব্যক্তিগত সহকারী আগেই ছবি তুলতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি না করাতেই সে ছবি তুলেনি। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাইয়ের আগ্রহে আমি ছবি তুললাম এবং বললাম আপনি না হাসলে ছবি পরিপূর্ণ হবে না। মহিউদ্দিন ভাই এমন বিস্ময়কর আনন্দের হাসি দিলেন এ রকম হাসি আমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের মুখে আর কখনও দেখিনি। আরও অনেক কিছু বলার আছে, বলার থাকবে যা ভবিষ্যতে বলব। তবে এ মুহূর্তে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো উত্থাপন করলাম তা হলো প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহিউদ্দিন ভাইয়ের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব এবং চির জাগরূক রাখার জন্য তাঁর সন্তান ব্যারিস্টার নওফেলকে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটি উঁচু অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। চট্টগ্রামবাসীর সন্তান নওফেল চট্টলবীরের সন্তান হিসেবে তার যোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা, যুক্তি উপস্থাপন, দলীয়-বঙ্গবন্ধু-নেত্রীর আদর্শ উপস্থাপন এবং বিগত ১০ বছরের ঈর্ষণীয় অর্জনগুলো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সূচারু এবং নান্দনিক বাগ্মিতার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা মহিউদ্দিন ভাইকে সম্মানিত করার লক্ষ্যেই তাঁর সুযোগ্য সন্তানকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করেছেন। চট্টগ্রামে একটি বিষয় বহুকাল থেকে প্রচলিত যে, চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় সন্তান নওফেল যে আসনে নির্বাচন করছেন, সে আসনে যে দল নির্বাচিত হয়, সে দলই সরকার গঠন করে। ব্যারিস্টার নওফেল অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে তারুণ্যের উদ্দীপ্ত উচ্ছ্বাস এবং জ্ঞান-গরিমায় যেভাবে মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনে তাকে তাঁর পিতার মতো বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার মানবতার জননী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুনরায় অধিষ্ঠিত করার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম
×