ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ভোটগুলো ঠিক ঠিক প্রার্থীর নামে যোগ হবে তো?

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

ভোটগুলো ঠিক ঠিক প্রার্থীর নামে যোগ হবে তো?

কেন জানি না মনে একটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহনকারী জোট বিপুল ভোট লাভ করবে; কিন্তু সেই ভোট যথাযথ প্রার্থীর নামে যোগ হবে তো? শঙ্কার প্রথম কারণ, ২০০১-এর মহাবিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সফল অর্থমন্ত্রী ও সব ক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক এবং দক্ষ পরিচালনায় সফলতা অর্জন করার পর সারাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, যা অনেক প্রার্থী-নেতাকর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর চরম নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর ত্যাগে বাধ্য করার পরও বিজয়ী হওয়ার মতোই ছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরে কম্পিউটার-ক্যু দ্বারা এ ফলটি পাল্টে যায়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতার কারণে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে- এ ধারণা ছিল শহর-গ্রামের রাজনীতিক থেকে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সবার। প্রথম শঙ্কিত হয়েছিলাম, আমাদের রাজনীতিক বন্ধুর মাধ্যমে দিল্লী থেকে একজন প্রখ্যাত রাজনীতিক কর্তৃক আওয়ামী লীগ-প্রধানের জন্য প্রেরিত বার্তা- এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হবে, তার সব কৌশল নির্ধারিত হয়েছে বিদেশী দুই রাষ্ট্রের সহায়তায়! এর নেপথ্য কারণ, দেশে প্রাপ্ত গ্যাস ভারতে রফতানি করার শর্ত শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সম্মত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত. তখনও এ তথ্য জানা হয়নি নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগের নেতারা শাহ কিবরিয়ার নেতৃত্বে সাক্ষাত করে টিভিতে তাদের বেরিয়ে আসার স্পষ্ট দেখা দৃশ্যে শাহ কিবরিয়ার গম্ভীর, বিষণ্ণ, মুখচ্ছবি দেখেছি, যা আজও ভুলতে পারিনি। অপরদিকে, একই রকম সাক্ষাতকার শেষে বিএনপির নেতাদের নেতৃত্বদানকারী খালেদা জিয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও বিএনপি নেতাদের আনন্দিত ভাব প্রকাশ হয়েছিল। বলা বাহুল্য, টিভিতে দেখা এ দুটি দৃশ্য আমার মনে গভীর শঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের দুর্লভ এক সৌভাগ্য এই যে, ২০১৪ সালে নিন্দিত রাজনীতি না করার মুচলেকা দেয়া দুর্নীতির নায়ক, শাহ কিবরিয়া হত্যা, ২১ আগস্ট হত্যাকান্ডের পরিকল্পক তারেকের ঔদ্ধত্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে জয়ী হওয়া সরকারকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অগ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলে দেশ শাসনে সকল কীর্তি গড়া অসম্ভব মেধাবী, দূরদর্শী রাজনীতিক শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের শাসন লাভ করার ফলে বাংলাদেশ আজ বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গণ্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। যদিও ২০১৪-১৫ নির্বাচন প্রতিরোধ করার নামে বিএনপি-জামায়াত সারাদেশে হত্যা, লুট, হিন্দু-আদিবাসী নির্যাতন, গৃহ-দেশত্যাগে বাধ্য করা, জীবিকা ধ্বংস, রাজপথ কেটে খালে পরিণত করা, প্রায় বিশ হাজারের বেশি বৃক্ষ কর্তন, এরপর দেশব্যাপী পেট্রোলবোমা হামলা করে হাজার হাজার বাস-ট্রাক-রেল, কার, সিএনজির যাত্রী-চালক-হেলপারসহ পুড়িয়ে হত্যা করে! তাদের ধ্বংসাত্মক অপরাজনীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান, সততা, আন্তরিকতা, কর্মদক্ষতা, সর্বোপরি জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ ও গভীর দেশপ্রেমে জনগণ আস্থা রেখে সরকারকে, নিজেদের এবং স্বদেশকে সঠিকপথে রাখার যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বলে দেশ সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। তৃতীয়ত. ১৯৯৮ থেকে দেশে কাজী আরেফসহ জাসদের সন্ত্রাস-জঙ্গীবিরোধী সমাবেশে গুলি চালিয়ে তাদের পাঁচ-ছয়জন নেতা হত্যা, এর পরপরই উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা এবং পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মাধ্যমে যে পরিকল্পিত হত্যাকা-গুলো সংঘটিত করা হয়েছিল সেগুলোর নেপথ্যে মদদদাতা ছিল খালেদা-তারেকের বিএনপি। এরাই ২০০২ থেকে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় দিয়ে মৌলবাদী তালেবানী জঙ্গীগোষ্ঠীর জন্ম দেয়! এই জঙ্গীদের মধ্যে কুখ্যাত জঙ্গী বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, হরকত-উল-জিহাদের মুফতি আবদুল হান্নান, তাইজউদ্দীন প্রমুখ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো জঙ্গী অধ্যুষিত মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছিল। পঞ্চাশের বেশি তালেবানী জঙ্গীগোষ্ঠী এ দেশকে শরিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে নিয়োজিত হয়েছিল, যাদের জন্ম দিয়ে তারেক রহমান চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ধ্বংস সাধন করা। এই পটভূমিতে জাতিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বর্তমান ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির এবং যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্র-জঙ্গী, দুর্নীতিবাজ, খুনী দেশবিরোধী শক্তির মধ্যকার লড়াই হিসেবে গণ্য করতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে- ২০০১-এ আসলে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত বিপুল ভোট বিএনপির নামে স্থানান্তর করে কম্পিউটার-ক্যু করা হয়েছিল। সে কালো পদ্ধতিকে নিষ্ক্রিয় রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন অফিসের কমিশনারদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্টদের অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীদের ভোটের ফল পরিবর্তন করার চেষ্টা হয়! এটি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্ট স্বেচ্ছায় বেরিয়ে চলে গিয়ে প্রচার করেছে তাদের মারপিট করে বের করে দেয়া হয়েছে। যা ছিল মিথ্যা। এ জন্য ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত সব দলের পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। জাতি জানে- বিএনপি টাকা বিতরণ করে ভোট কিনবে, দুর্বল সংখ্যালঘু হিন্দু-আদিবাসীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদানে বাধা দেবে। এখন দেখা যাচ্ছে- ডিসি রিটার্নিং প্রিসাইডিং অফিসারকেসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি একত্রে নাশকতা করার চেষ্টা করছে- বোমা, অস্ত্র, পেট্রোলবোমা, বিস্ফোরকসহ অনেক জঙ্গী-সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়ে প্রমাণ করেছে তারা যে কোন সময় সুযোগ পেলেই বড় ধরনের নাশকতা, হত্যাকা- ঘটাবে। সুতরাং এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় অফিসে সব দলের সব প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট নিরপেক্ষতার সঙ্গে সঠিক ভোট সংখ্যা উল্লিখিত হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা- যা নির্বাচন কমিশনের সব কমিশনারের এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পবিত্র জাতীয় দায়িত্ব। এই ব্যবস্থাটি ফুল প্রুফ করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে একটি বাড়তি দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। পুরো দেশের সব ভোটকেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টের উপস্থিতি এবং ভোটদানের পর ফল ঘোষণা পর্যন্ত তারা যেন ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সম্ভবত ভোটকেন্দ্র থেকে কোন কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট ফল ঘোষণা পর্যন্ত কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে বাধ্য- এমন নির্দেশনা প্রদান করেছে। এখন এটি নিশ্চিত করে সব দলের পোলিং এজেন্টের উপস্থিতিতে ফল ঘোষণা করা সুষ্ঠু নির্বাচনকে সম্ভব করবে। সব ভোটকেন্দ্রের ফলের যোগফল কেন্দ্রে বদলানো সম্ভব হবে না। এ লেখা লিখতে লিখতে জানা গেল, বিএনপির ষড়যন্ত্রী নেতা, মি. টেন পার্সেন্টের উদ্যোগ তার হাওয়া ভবন রাজত্বের সহকর্মী ব্যবসায়ীদের কাছে প্রচুর অর্থ পাঠিয়েছে। এদের একজন নগদ আট কোটি ও দশ কোটি টাকার চেকসহ গ্রেফতার হয়েছে, যে অর্থ দুবাই থেকে পাঠানো হয়েছে এবং গ্রাম-গঞ্জে, শহরের নিম্নবিত্তের ভোট কেনায় এ অর্থ ব্যবহার করা হবে বলে জানা গেছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, এমন দেড় শ’ কোটি টাকা সারাদেশে ছড়ানো হয়েছে। এদিকে ড. কামাল হোসেন ইসি প্রধানকে পুলিশ বাহিনী ‘তার জানোয়ার বাহিনী’ বলে ক্রোধ প্রকাশ করলে ইসি প্রধান জাতীয় একটি নিরাপত্তা বাহিনীকে এই অনাকাক্সিক্ষত ভাষায় গালি দিতে পারেন না বলে এক তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সম্ভবত এটি তারা ওয়াকআউট করার, পরবর্তীতে নির্বাচন বর্জন করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার জন্য করে থাকতে পারেন। হয়ত নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এখনই দিলে জনগণ তাদের রাজনীতিতে অনির্ভরযোগ্য দল ও ব্যক্তি গণ্য করার সম্ভাবনা থাকায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ ও নতুন নিরপেক্ষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের দাবি জানালেন। এ দাবি এবং ইসির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রের পাহাড় তৈরির প্রেক্ষিতে মনে পড়ে গেল, ২০০১-এর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন অভিযোগ করেছিল খালেদা জিয়া, অথচ যিনি তাদের পক্ষেই কাজ করেছিলেন। এবার বিএনপি প্রার্থীরা সম্ভবত ব্যক্তি হিসেবে একজন একজন করে নির্বাচন বর্জন করতে পারে। দলীয়ভাবে বর্জন করা সম্ভবত সম্ভব হবে না। কারণ জামায়াত বিএনপি হয়ে নির্বাচন করছে যারা বর্জন করবে না। ঐক্যফ্রন্টের যারা জিতবে না তারা একে একে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে বলে ধারণা হয়। সবকিছুর ওপরে একটা প্রশ্ন মনে জাগছে তাহলে কি জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেকের পর আইএসআই-এর পক্ষের ব্যক্তি ড. কামাল হোসেন? তিনিই তো এখন যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হয়ে উঠলেন, তাই নয় কি? সে জন্য মুক্তিযুদ্ধপন্থী সব পক্ষকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব ধাপ পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×