ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 শিল্পাচার্য জয়নুল  আবেদিনের  জন্মদিন আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিল্পের মুখ্য শর্ত হচ্ছে সারল্য। শিল্প হবে চিন্তার অকপট প্রকাশ। এমন ভাবনায় ক্যানভাস রাঙিয়ে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিল্পের আবেদন। রুচির দুর্ভিক্ষ সরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন শিল্পের পথরেখা। তাঁর রং তুলির আঁচড়েই এদেশে চারুকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি তার আপন মনন ও সৃজনশীলতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত করেছেন বাংলার চিত্রকলার ভুবনকে। অনন্য সব শিল্প সৃষ্টি করে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিস্বরূপ। আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের পথ দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। শুধু তাই নয়, বাংলার চারুশিল্প আন্দোলনেও রেখেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। আজ শনিবার কিংবদন্তি এই শিল্পীর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৫তম জন্মদিন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী। শিল্পাচার্যের জয়ন্তী উদ্্যাপন ও চারুলকলার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাবির চারুকলা অনুষদ পাঁচদিন ব্যাপী জয়নুল উৎসবের আয়োজন করেছে। চারুকলার লিচুতলায় জয়নুল মেলা, চারু শিক্ষার্থীদের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সজ্জিত বর্ণিল এ উৎসবের শেষ দিন আজ শনিবার। আজ সকালে চারুকলার বকুলতলা মঞ্চে উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে দেয়া হবে জয়নুল সম্মাননা। বাংলাদেশে চারুকলার চর্চা ও আন্দোলনের পথের দিশারী বিরল প্রতিভার অধিকারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ ও মা জয়নাবুন্নেছা। বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত, সুনিবিড় ও রূপময় প্রাকৃতিক পরিবেশে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রং তুলির খেলায় ফুল-ফল, বৃক্ষ, লতাপাতা, মাছ, পাখিসহ নানা বিষয় মেলে ধরতেন ক্যানভাসে। আর এই ছবি আঁকার টানেই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। আশ্রয় নেন কলকাতায়। ভর্তি হন গবর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ’৩৮ সাল পর্যন্ত এখানেই চলে শিল্পাচার্যের চারুশিক্ষার দীক্ষা। ’৩৮ সালে ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রী। ততদিনে শিল্পী হিসেবেও শিল্পরসিকদের স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছেন। স্থান করে নেন মুষ্টিমেয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর তালিকায়। এরপর কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। এদেশের শিল্পের ভিত রচনায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জয়নুল আবেদিন। তাঁর হাত ধরেই এদেশে চারুশিল্প মাধ্যম বিকশিত হয়। ’৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয়। ’৬৭ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এদেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাক্সক্ষায় ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ’৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ’৭৪ পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ’৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমির অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। শিল্পী জীবনে রং তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঁকেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ’৬৯ সালে তার ক্যানভাসে উঠে আসে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ’৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম নবান্ন। এ বছরেই মনপুরা নামে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের হƒদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি। শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য্য, দারিদ্র্য ও বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর তুলিতে ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন। শিল্পকলার সুবাদে বাঙালী সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেন বিশ্বসভায়। একইসঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত রাখেন। ’৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকানিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরবর্তীতে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। তাঁরা হলেন- সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ’৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
×